গত বছর ফেব্রুয়ারিতে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) এক ছাত্রীকে বিভৎসভাবে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদাসহ ৫ ছাত্রী উচ্চ আদালতের নির্দেশে বহিষ্কার হলে দেশে এ ধরনের ঘটনা কমে গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি ফের একই ধরনের ঘটনা ঘটল ইবিতে।
২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের আল ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের এক নবীন ছাত্রকে হলরুমে র্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। ওই ছাত্রকেও বিবস্ত্র করে রাতভর নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী অভিযোগ করলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতেই ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রী মহুয়া আক্তার এক ছাত্রী নেত্রীকে ৩০ হাজার ঘুষ দিয়ে গণরুমে উঠেছিলেন, কিন্তু তাকে সিট না দিয়ে অন্য আরেক ছাত্রীকে রুম দেয়ার বিষয়ে কথা বলতে গেলে ওই নেত্রী হকিস্টিক দিয়ে মহুয়াকে বেদম পেটান এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারতে উদ্যত হন। শিক্ষিকা এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের হস্তক্ষেপে মহুয়া ছুরিকাঘাত থেকে রেহাই পান। দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমনটা হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থীর পেছনে বাবা-মাসহ পুরো পরিবারের অনেক প্রত্যাশা থাকে। জীবনে বেশকিছু পথ অতিক্রম করে একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। এ সময় তাদের যথেষ্ট দায়িত্বশীল আচরণ করার কথা।
বাংলাদেশে র্যাগিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সিনিয়র কর্তৃক নবাবগতদের নির্যাতন করা এখন প্রায় নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগস্ট ’২২-এ ইডেনে ২ শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় তুমুল প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। এরপর ইবিতে ফুলপরি নির্যাতনের ঘটনায় উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে নির্দেশনা দিয়েছিল। কদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করা হয়। সর্বশেষ ফের ইবিতে বিবস্ত্র করে ছাত্র নির্যাতন।
এসব ক্ষেত্রে ২টি বিষয় কমন। প্রথমত এসব ঘটনায় সরকারি দলে ছাত্র সংগঠনে ছাত্রলীগের নাম আসছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে এসব ঘটনা বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন সমাজের অগ্রসর অংশ, তাদের এই হিংস্রতা এই রুচি বিপর্যের কারণ কী?
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিন্তু এ ধরনের ঘটনার সাথে জড়িত নয় বরং তারা কেউ অপকর্মের জড়িত হলে সাতে সাথে দল থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হচ্ছে। অপরাধী সরকারি দলের কর্মী বা নেতা হিসেবে কোনো আইনি আনুক‚ল্য পাচ্ছেন না। কিন্তু তারপরও ঘটছে। আর বিবস্ত্র করে চিত্র ধারণ করা হচ্ছে যাতে ভিকটিমকে ভয় দেখানো যায়, আর ইডেনে তো ব্ল্যাককমেইল করে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে ভিকটিমকে বাধ্য করা হতো বলে পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল।
যে দেশে শিক্ষার্থীরা ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৭০-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই দেশের শিক্ষার্থীরাই এসব কী করছে! একটা সময় পর্যন্ত বলা হতো সামরিক শাসকরা শিক্ষাঙ্গন নষ্ট করছে। কিন্তু ৩০ বছর তো দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলছে। আসলে সমাজব্যবস্থারই পচন ধরেছে। ব্যবসায়ীরা লুটপাট করছেন, শিক্ষার্থীরা ধর্ষণ-বিবস্ত্র করছে, শিশুরা (কিশোর গ্যাং) খুনোখুনি করছে, পারিবারিক সহিংসতা চরম রূপ নিয়েছে। সব মিলিয়ে সামাজিক বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী মনোবিজ্ঞানী, সুশিল সমাজকে নিয়ে রাজনীতিবিদদের বসতে হবে। সমাজের যে অসুখ তার চিকিৎসা না হলে এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে না।