ই-পেপার বাংলা কনভার্টার বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৪ আশ্বিন ১৪৩১
ই-পেপার বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ব্রেকিং নিউজ: সেনাবাহিনীর অফিসারদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার সুফল জনগণ ভোগ করবে      নারায়ণগঞ্জে পারভেজ হত্যা মামলায় সাবেক মন্ত্রী গাজীর ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর      গাছ লাগানোর বিষয়টি আত্মায় ধারণ করা উচিৎ: বন উপদেষ্টা       ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের ৩য় ও ৪র্থ বর্ষের ফরম পূরণের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ      ভরা মৌসুমে ক্রেতার নাগালের বাইরে রুপালি ইলিশ      




ভয় কাটানোই প্রথম কাজ
কাজী আব্দুল হান্নান
Published : Sunday, 15 September, 2024 at 1:07 PM
রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে দেশ কঠিন সংকটকাল পার করছে। প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রনের অভাবে সর্বত্র ‘মব জাস্টিস’এর আতঙ্কে ভুগছে মানুষ। মাস দুই হলো অধিকাংশ মানুষের স্বাভাবিক আয় রোজগার ব্যহত হচ্ছে। সরকারী চাকরিজীবীদের কর্মক্ষেত্রে বিরাজ করছে অস্থিতিশীল কর্মপরিবেশ। ব্যংক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে থামছে না ব্যবস্থাপনা দখল-বদলের অশুভ প্রবনতা। এরমধ্যেই নাশকতার আগুনে পুড়েছে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বৃহৎ অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠান। খোদ প্রধান উপদেষ্টা পর্যন্ত জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে গার্মেন্ট ও ওষুধ শিল্পের নাম উল্লেখ করে পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

শ্রমজীবী কর্মহীন মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। সঞ্চিত অর্থে দিনযাপনের শেষ পথটিতেও ব্যাংকিং খাতের দূরাবস্থার কারনে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য অনিশ্চিয়তা তৈরী করেছে। দেশজুড়ে একটা ভীতির আবহ বিরাজ করছে। বিদেশী ক্রেতা-বিক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। জনমনে উদ্বেগ এবং ভবিষ্যত নিয়ে উৎকন্ঠা চলছে। ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সামাজে অসন্তোষ ও বিভাজন বেড়েছে। অথচ এখন বিভক্তি নয়, দেশকে সংহত করার সময়।

অতীতের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রশাসনের ব্যর্থতা বা অবহেলা দেখাগেলেই সমাজে অস্থিরতা ও সহিংসতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট হলে সমাজে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। জনসাধারণের  মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবনতা বৃদ্ধি পায়। 

জনআস্থার অভাব অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও সরাসরি বাধাগ্রস্ত করে। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রশাসনের প্রতি ব্যবসায়ী মহল আস্থা না রাখায় তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ এখন কমে যাচ্ছে। তারা মনে করছে যে তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষিত থাকবে না। দেশটির অর্থনীতির ওপর যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং সার্বিকভাবে উন্নয়ন মন্থর হচ্ছে।  

বাংলাদেশে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে সমাজে যা হচ্ছে, বিপ্লবের পর যে কোন দেশের জন্য তা নাকি স্বাভাবিক ঘটনা। বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর রাষ্ট্রে ও সমাজে অরাজকতা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। যে কোনো অভ্যুত্থানেরই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য– হচ্ছে, কিছু মানুষের আইন-কানুনের ভয় ভেঙে যাওয়া। ভয় ভাঙে একত্র হয়ে বল প্রয়োগের শক্তি অর্জিত হবার কারণে। বাংলাদেশের চলতি ঘটনাগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। 

সরকারের পরিবর্তনের সাথে সাথে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্বল হয়েছে। অপরাধ বৃদ্ধি, নিরাপত্তাহীনতা এবং জনগণের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। পুলিশ এখনও পরিপুর্নভাবে কাজ করার মত পরিস্থিতিতে আসেনি। 

দেশে এখন অনেক ক্ষেত্রেই চলছে অরাজক অবস্থ্া জোর করে পদত্যাগ করানো হচ্ছে, চাকরি থেকে অবসরে পাঠানো, কিংবা বরখাস্ত করানো হচ্ছে, জোর করে পরীক্ষা বাতিল করা হচ্ছে, হয়রানিমূলক মামলায় যেমন খুশি নাম যুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী নির্বিশেষে সবাই থাকছেন এসব মামলার তালিকায়। 

স্বৈরাচারের দালাল বা দোসর ট্যাগ লাগিয়ে রাজধানী থেকে মফস্বল সর্বত্র আইন হাতে তুলে নিয়ে ‘মব জাস্টিস’ চলছে। ‘উইচ হান্টিং’ করতে গিয়ে একের পর এক উদ্দেশ্যমূলক মামলা, হামলা, কোর্ট-পাড়ায় আসামীর ওপর হামলা, জোর করে পদত্যাগ স্বাভাবিক ব্যাপার। শুধু তাই নয়, পতিত সরকারী দলের রাজনীতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার বক্তব্যও উচ্চারিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ একটা ধর্ম; তাদের সংস্কৃতি আছে, পোশাক আছে, চিন্তা আছে এসব কিছু উপড়ে ফেলতে হবে। এটিকেই বলা হয় প্রতিশোধ স্পৃহা।
বিপ্লবোত্তর সমাজে এসব হতেই পারে গণ্যকরে এর বিরুদ্ধে সরকারের আইনানুগ পদক্ষেপ থেমে থাকছে। প্রকারান্তরে যার মাধ্যমে প্রতিহিংসা পরায়নতার মানসিকতা উৎসাহিত হচ্ছে। 

স্বৈরাচারী সরকারদের মানসিক দূর্বলতা থেকে জন্মনেয় সন্দেহ-বাতিক। এটি নিচের দিকে, অর্থাৎ সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সাধারণ জনতাকেও প্রভাবিত করে। মানুষের মাঝেও সন্দেহের মানসিকতা গড়ে ওঠে। বিগত আমলেও দেখা গেছে আন্দোলন দেখলেই সরকার আঁতকে উঠতো। বিরোধীদের আন্দোলনের ঘোষণা শুনলেই বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার করতে দেখা যেতো। সব সময় সব কিছুতে ‘সন্দেহ’ করা, ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়াই ছিল বৈশিষ্ট্য। এই সন্দেহ তাকে নির্মম অপরাধ করতে পর্যন্ত উদ্বুদ্ধ করেছিল। সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধানের পথে না হেঁটে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখার পরিনতি ভোগ করেছে বিগত সরকার। প্রমান হয়েছে, ষড়যন্ত্রের তত্ত¡ দিয়ে সবকিছুকে উড়িয়ে দেয়া হলে সমস্যার সমাধান করা যায় না। এটা একনায়কতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদি অসুখ।

কর্তৃত্ববাদের দ্বিতীয় একটি আচরণ হলো অনুসারীদের মধ্যে অতীতাশ্রয়ী হয়ে প্রতিশোধের আগুন প্রজ্বলিত করা। যা গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। তাই কর্তৃত্ববাদী চেতনা মুক্ত না হলে অনেক সময় বিপ্লব বেহাত হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস যার উদাহরণ। ফরাসি বিপ্লবের পর বিপ্লবের শত্রæ হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে গিলোটিনে শিরচ্ছেদ করা হয়। রাজপরিবার, অভিজাত, পুরোহিত, এমনকি বিপ্লবী সরকারের ভেতরেই থাকা বিরোধীরাও তা থেকে নিষ্কৃতি পায়নি। পরিনতিতে নেতৃত্ব দানকারী বিপ্লবী সরকারের পতন হয়। 

ইলিনয় ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত “আফটার দ্য রিভ্যুলিউশান” প্রবন্ধে পোল্যান্ডের ইতিহাসবিদ, গবেষক এবং সাংবাদিক অ্যাডাম মিচনিক লিখেছেন, “প্রতিশোধ-পরায়ণ মনোভাব উগ্র জাতীয়তাবাদ তৈরিতে সহায়তা করে। যেটি বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা এবং প্রতিহিংসায় পরিণত হয়। যা শুধু বিপ্লবের মূল্যবোধকেই দুর্বল করে না, বরং উদীয়মান গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলাকেও হুমকির মুখে ফেলে দেয়।”

তাই প্রতিশোধ-পরায়ণ হয়ে অবাধ মামলা গ্রহণের ইতিবাচক দিক যেমন আছে, নেতিবাচক প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে প্রতিহিংসার আগুনে ঘৃতাহুতির দিকটি। আবার অতি দ্রæত আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে না পারলে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেংগে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এরজন্য মামলা গ্রহন করে নিষ্পত্তির জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার দিকে বিশেষ মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। দ্রুত ও কার্যকর বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাটাও জরুরী। নতুবা বিচারালয় আবারও প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হবে।

আর্থিক সংকট মোকাবেলার জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে একথা অস্বীকার করা যায় না। অর্থনীতির বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। যা সময় সাপেক্ষ। কিন্তু এরমধ্যেই উদ্ভুত অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণের কাজকে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার। সাথে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা সুবিধাজনক পরিবেশ রক্ষা করছে কিনা সে নজরদারিটাও থাকা দরকার। ব্যবসা এবং বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনা দিতে সরকারের আগ্রহ স্পষ্ট হওয়ার ওপর নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট সবার সক্রিয়তা। নিয়ম-কানুনের সুষম বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার চেষ্টা কি চলছে তার জানান দেয়াটাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

একথা ঠিক যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক চাপের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। তারপরও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এবং অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে সরকারকে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে অগ্রসর হতে হবে। বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো, এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ আশাকরা যায় না। অর্থনৈতিক এবং সম্পদের ভারসাম্য ঠিক করতে অনেক বিষয়ে সংস্কার করতে হবে এটা যেমন সত্য, তেমনি সংস্কারের আগে বিনিয়োগ এবং ব্যবসার নিরাপত্তা নিয়ে যে ভীতিকর অবস্থা তৈরী হয়েছে সবার আগে তা দূর করতে হবে। কিন্তু সবকিছু একসাথে করতে গেলে যে লেজে-গোবরে অবস্থা তৈরী হবে তা থেকে বেরিয়ে আসা এখনকার চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে যাবে।







সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক : কে.এম. বেলায়েত হোসেন
৪-ডি, মেহেরবা প্লাজা, ৩৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত এবং মনিরামপুর প্রিন্টিং প্রেস ৭৬/এ নয়াপল্টন, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]