ই-পেপার শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
শিরোনাম: মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ও ফেসবুক চালুর বিষয়ে যা জানা গেলো       নেপালে বিমান বিধ্বস্ত, নিহত ১৮       আগামী ৩-৪ দিনের মধ্যে সব নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী       খুলেছে অফিস-আদালত, গণপরিবহন সংকটে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি        বান্দরবানে কেএনএফের দুই সদস্য নিহত       লাখাইয়ে রোপা আমন ধানের বীজতলা তৈরীতে ব্যস্ত কৃষক       ভৈরবে কোটা আন্দোলনকারী ও র‌্যাব-পুলিশের সংঘর্ষ, টিয়ারসেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ       




একুশের শপথ হোক অন্যায়ের কাছে মাথানত না করা
রায়হান আহমেদ তপাদার
Published : Sunday, 11 February, 2024 at 7:01 PM, Update: 11.02.2024 7:51:31 PM
বাঙালির অধিকার সচেতনতার অভাবে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাই, বাঙালিরা কখনোই তাদের স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে উদ্যমী এবং মরিয়া ছিল না। তাই সর্বপ্রথম বাঙালি জাতি ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছিল এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে ছিল বদ্ধপরিকর এবং সচেতন। অতএব, বলা যায় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালির মধ্যে অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালি জাতির ইতিহাস হলো আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বেনিয়াদের উপমহাদেশ থেকে বিদায় করতে সক্ষম হয়। ব্রিটিশদের বিতাড়িত করার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর এর দুটি অংশের মাঝে ধর্মের মিল ছাড়া অন্য কোনো মিল ছিল না। শুরু থেকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর ফলে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৪৭ থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন ১৯৫২ সালে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। বাংলার ইতিহাসে পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে এটাই ছিল বাঙালি জাতির প্রথম বিদ্রোহ। বছর পরিক্রমায় একে একে ১১টি মাস অতিক্রম করে আবার আমাদের মাঝে উপস্থিত হচ্ছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। আর তাই তো বলি, একুশ মানে মায়ের মুখের হাসি, একুশ আমার মায়ের হাতের রঙিন কাচের চুড়ি, একুশ আমার প্রিয় ভাষায় স্বাধীন মনের বুলি, একুশ আমার কৃষক ভাইয়ের একমুঠো ধান, একুশ আমার বাউল মনে সুরের ঐক্যতান, একুশ মানে ফাগুনের আগুনরাঙা ফুল, একুশ মানে লক্ষ্য নির্ভুল।

একুশ মানে বাঙালি জাতির অহংকার। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলার আয়োজন করা হয়। ভাষা আন্দোলনের গৌরবের স্মৃতিকে অম্লান রাখতেই বইমেলার নামকরণ হয় ‘অমর একুশে বইমেলা।অমর একুশে বইমেলা আমাদের মাতৃভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিকাশের অঙ্গীকারকে মনে করিয়ে দেয়। তাই প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। এই সবকিছুই ৫২-এর শহীদদের দান। ১৯৪৭ সালে বাঙালিরা পাকিস্তানের অংশ হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানি সরকার ঘোষণা করে যে, উর্ধুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র মাতৃভাষা। সেই সময় ছাত্র-জনতার সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করে। তখন থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন আন্দোলন-সমাবেশ। এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে ১৯৫২সালে।২১শে ফেব্রুয়ারি এ দেশের দামাল সন্তানেরা ১৪৪ধারা ভঙ্গ করে ভাষার জন্য আন্দোলন করে। ১৪৪ ধারা অমাননার অজুহাতে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। সে গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার নাম না জানা আরো অনেকে। তবু আন্দোলন থেমে যায় নাই। আন্দোলন চলে। শহীদদের রক্তে রন্ঞ্জিত হয় রাজপথ। শোকাবহ এই ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পরে। ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। এটি ছিল বাঙালীদের পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রথম বিজয়। আমরা বাঙালি হলাম প্রথম জাতি যারা নিজের ভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। ভাষার জন্য বাংলার দামাল সন্তানদের আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' ঘোষণা করে। এই ঘোষণাটি আমাদের ভাষা আন্দোলন তথা বাংলাদেশের মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি করেছে।

ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় চেতনার এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি বাঙ্গালীদের কাছে যেমন আনন্দের, তেমনি বেদনাপূর্ণের। তাই দিনটি আমরা আনন্দ-অশ্রু মিশিয়ে পালন করি। ভাষার জন্য যে আন্দোলন করতে হয় ও জীবন দিতে হয় তার একমাত্র নজির সারাবিশ্বের মধ্যে আমাদেরই রয়ছে। তাই তো একুশ আমার অহংকার। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিও আমাদের জাতীয় জীবনে এই সংকট নেমে এসেছিল। ধর্মের সঙ্গে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সংঘাত বাধিয়ে দিয়েছিল। এ সংঘাত থেকে রক্ষা করেছেন একুশের আত্মদানকারীরা। আত্মত্যাগের ওপর সভ্যতার ভিত রচিত হয়। এ কথা বললে ভুল হবে না যে, বাঙালির সভ্যতার ভিত রচিত হয়েছে একুশের শহীদের আত্মদানের ওপর। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-কোনোকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয় লক্ষ্মী নারী। বিশ্ব জুড়ে সব মহৎ কাজে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান আছে। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ অবধি আছে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের সমৃদ্ধ ইতিহাস। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবির আন্দোলনে সহযোদ্ধা হয়ে পুরুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নারীরা। পাকিস্তান আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে ভাষার দাবির মিছিলগুলোতে সামনের কাতারে ছিলেন নারীরাও যাই হোক,ভাষার দাবি মেনে নিলেও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে পাকিস্তানিদের দ্বারা বাঙালিদের শোষণ ও বৈষম্য চলতেই থাকল। ফলে ভাষার জন্য আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটলেও অধিকারের জন্য আন্দোলন চলতেই থাকল।তারই ধারাবাহিকতায় অধিকার, স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসন এবং সবশেষে স্বাধীনতার জন্য আমাদের সংগ্রাম করতে হলো। আমরা যুদ্ধজয় করে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ পেলাম।

পৃথিবীতে খুব কম রাষ্ট্রই আছে, যাদের রাষ্ট্রের নাম হয়েছে ভাষার নামে। সাধারণত দেশের নামে ভাষার নাম হয়েছে তেমনটাই দেখতে পাওয়া যায়।এখানেও একুশের চেতনাই জড়িত ভাষা আন্দোলন বিষয়টি নিতান্তই ভাষার জন্য ছিল না, পুরো বিষয়টিই ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির মুখের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রত্যক্ষ আন্দোলন। বাঙালির মুখের ভাষা যাতে কেউ কেড়ে নিতে না পারে, সেজন্য প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল। আর এ সচেতনতার কারণেই ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে বাঙালি সফল হয়। ভাষাই মানুষকে মানুষ করে তোলে।নির্মম সত্য কথা। মানুষের ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন, রাষ্ট্রজীবন ও জাতীয় জীবনের বিকাশ ঘটে ভাষার মাধ্যমে। ভাষা মানুষের বেঁচে থাকার হাতিয়ার। এ হাতিয়ার কেড়ে নিতে চেয়েছিল শাসকরা। রুখে দিয়েছিল ভাষাশহীদরা। যে মানুষের মতো মানুষ হতে হলে চাই মাতৃভাষা, চাই নিজেদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি। একুশে ফেব্রুয়ারি ইতিহাসকে সফল করে তুলতে হলে মাতৃভাষা আর মাতৃভাষার সাহিত্যকে আমাদের জীবনের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। করতে হবে তাকে সব জ্ঞানের বাহন। একুশের শহীদরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে প্রমাণ করেছেন, আমরা জাতি হিসেবে মহত্ত্বভ্রষ্ট নই, প্রাণহীন নই, জীবন্মৃত নই, প্রাণের যে বৈশিষ্ট্য তা আমাদের আছে। প্রাণ দিয়েই আমরা প্রাণের মূল্য রক্ষা করেছি, জীবন দিয়ে জীবনের মর্যাদা খাড়া করেছি। রক্ত দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। মানুষ কল্পনা করে, স্বপ্ন দেখে, প্রেমে, বিরহে অশ্রুবর্ষণ করে, বিদ্রোহে প্রতিবাদে জেগে ওঠে মাতৃভাষার মাধ্যমে। ধার করা ভাষায় পণ্ডিত হওয়া যায়, মানুষ হওয়া যায় না। তাই তো বলি, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।

একুশের চেতনায় পরবর্তী সময়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সেই শপথেরই সফল বাস্তবায়ন দেখিয়ে চলেছে। একুশের শহীদরা সেই গোঁজামিল থেকে বাঙালি জাতিকে রক্ষা করেছে, কাপুরুষতার গ্লানি থেকে বাঁচিয়েছে। তাই তাদের আমরা স্মরণ করবো আত্মতৃপ্তির শৃঙ্খলে সীমাবদ্ধ হওয়ার জন্য নয়, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, দরকার হলে আরো রক্ত দিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য। আবুল ফজলও বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত। এ ঐতিহ্য থেকে আমরা প্রেরণা সংগ্রহ করবো, সঞ্চয় করবো শক্তি ও সাহস। কিন্তু আমাদের পদক্ষেপ হবে সামনের দিকে, দৃষ্টি থাকবে ভবিষ্যতের পানে এবং আমরা এগিয়ে যাবো মহত্তর ত্যাগের নবতর সংকল্প বুকে নিয়ে। একুশের শপথ হবে অন্যায়ের কাছে মাথানত না করা। একুশে ফেব্রুয়ারি ইতিহাসকে সফল করে তুলতে হলে মাতৃভাষা আর মাতৃভাষার সাহিত্যকে আমাদের জীবনের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।করতে হবে তাকে সব জ্ঞানের বাহন।একুশের চেতনা আমাদের শিখিয়েছে কি ভাবে ধর্ম-বর্ণ জাতি গোত্র নির্বিশেষে সবাই কাঁধে কাঁধ রেখে চলতে হয়, কিভাবে একসাথে লড়াই করতে হয়। ভাষা আন্দোলনের বাংলার তরুন ছাত্রসমাজের যে উদ্ভব ঘটেছিল বর্তমানে সেই ছাত্র রাজনীতি আজ দেশের এক বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। একুশ আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয় কি ভাবে অধিকার আদায় করতে হয়।কি ভাবে বিপদের সময় দেশের পাশে দাঁড়াতে হয়। আমরা আমাদের সোনার বাংলাকে বিশ্বের দরবারে এক উঁচু আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আমরা পারবোই কারণ আমাদের চেতনায় অমর একুশ আছে, আমাদের রক্তে মুক্তিযুদ্ধ আছে। তাইতো ভাষার মাসে দীপ্ত কন্ঠে বলতে হয়, একুশ মানে ফিরে পাওয়া,আমাদের সকল অধিকার।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 







সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক : কে.এম. বেলায়েত হোসেন
৪-ডি, মেহেরবা প্লাজা, ৩৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত এবং মনিরামপুর প্রিন্টিং প্রেস ৭৬/এ নয়াপল্টন, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স: ৪১০৫২২৪৫, ৪১০৫২২৪৬, ০১৭৭৫-৩৭১১৬৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন: ৪১০৫২২৫৮
ই-মেইল : [email protected], [email protected], [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
পিএবিএক্স: ৪১০৫২২৪৫, ৪১০৫২২৪৬, ০১৭৭৫-৩৭১১৬৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন: ৪১০৫২২৫৮
ই-মেইল : [email protected], [email protected], [email protected]