অর্থনীতির আকারের তুলনায় বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে। দেশে এখন ব্যাংক রয়েছে ৬১টি। বড় জালিয়াতি ও অনিয়ম উদ্ঘাটিত হয়েছে এমন ব্যাংকে সংকট বেশি। ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৬৩ শতাংশের বেশি আছে ১০ ব্যাংকে। মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে ১৪টি ব্যাংক। এর মধ্যে অনেকই লোকসানে। আবার পরিচালনা পর্ষদে সুশাসন ঘাটতির কারণে বেনামি ও ভুয়া ঋণ আর ফেরত আনতে না পেরে বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়েছে কয়েকটি ব্যাংক। ফলে কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করলেও ভালো না করলে টিকে থাকা যাবে না। সব মিলিয়ে ডজনখানেক ব্যাংক কমতে পারে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, কমিয়ে আনা হতে পারে দেশের ব্যাংকের সংখ্যা। এর মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার এ উদ্যোগ শিগগির গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ব্যাংকগুলোর এমডিদের পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো ও ভেঙে পড়া সুশাসন ফেরাতে ১৭ কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা বা প্রয়োজনে বন্ধ করার মতো পরিকল্পনাও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নানা কৌশলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যেও কয়েকটি ব্যাংকের দুরবস্থায় সমালোচিত হচ্ছে পুরো খাত। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ও খেলাপি ঋণ কমানোর ওপর জোর দিয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমানো, তারল্য সংকট ও মূলধন ঘাটতি থেকে বের হতে না পারলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে তদারকির এক পর্যায়ে দুর্বল কিছু ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শিডিউলড ব্যাংকস স্ট্যাটিস্টিকস প্রকাশনা থেকে জানা গেছে, দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়লেও চলমান মুল্যস্ফীতির চাপে গত তিন মাসে কোটিপতি হিসাবধারী কমেছে প্রায় ২ হাজার। এই সময়ে কোটিপতিদের ব্যাংকে থাকা আমানত কমেছে কমেছে ২৭ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। প্রকাশনার ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১ কোটি টাকার বেশি অর্থ জমা আছে এমন ব্যাংক হিসাব ১ লাখ ৬৭২৫টি। এসব অ্যাকাউন্টে জমা আছে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। যদিও গত জুনে মোট কোটিপতির হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৪৯৭টি। সেই হিসাবগুলোতে জমা টাকা ছিল ৬ লাখ ৮০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকার আমানত। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ফেরানো গেলে আস্থার সংকট কমে যাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে প্রতিটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, করপোরেট সুশাসন, তারল্য ও মূলধন পর্যালোচনা করা হবে। চলতি বছরের মার্চ, জুন, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর প্রান্তিকের তথ্য পর্যালোচনা করে আগামী বছরের মার্চ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হবে। প্রথম ধাপেই ব্যাংক একীভূত করা হবে না। শুরুতে বিভিন্ন সুবিধা বন্ধ করা হবে। এরপর একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এসব নিয়ে চার মাস ধরে আইএমএফের সঙ্গে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে কাজ চলছে। অবশ্য আইএমএফ কিছু না বললেও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার না করে উপায় নেই। তিনি আরো বলেন, ব্যাংকে টাকা রাখলে যে লাভ পাচ্ছে তার তুলনায় প্রপার্টিতে ইনভেস্ট করলে তারচেয়ে বেশি প্রফিট হচ্ছে। তাই এই টাকাগুলো সেদিকে চলে যাচ্ছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব আর কোটিপতির সংখ্যা কখনই এক নয়। এসব ব্যাংক হিসাবের গ্রাহকদের মধ্যে ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই বেশি। চলতি অর্থবছর থেকে মূল্যস্ফিতির পরিমাণ বাড়তে থাকায় অনেকে আমানতের টাকা ভেঙ্গে সংসার চালাচ্ছে; তাই মানুষের জামানো টাকা কমে আসছে। দেশে পরপর দুইমাস মূল্যস্ফিতির পরিমাণ ছিল ৯ শতাংশের উপরে। গত আগস্টে মুল্যস্ফিতি ছিল ৯.৫২%। এরআগে গত সেপ্টেম্বরে মুল্যস্ফিতি ছিল ৯.১০%। যদিও অক্টোবরে এসে মুল্যস্ফিতি কিছুটা কমে হয়েছে ৮.৯১%।
এ প্রসঙ্গে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গ্রাহক ব্যাংকে টাকা রাখলে আমানতের সুদহার পাচ্ছে গড়ে ৫% এর কম। তবে বিএসএস যে মুল্যস্ফিতির হার দিচ্ছে বাজারে, সেই তুলনায় জিনিসপত্রের দাম আরও বেশি। তাই গ্রাহক যে টাকা প্রফিট পাচ্ছে তার চেয়ে বেশি সংসার খরচে লাগছে। এ কারণে জমানো টাকা কমে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। মোট ঋণের পরিমাণ ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। তবে দুর্দশাগ্রস্ত তথা পুনঃতপশিল কিংবা অবলোপনের পরও আদায় না হওয়া ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি। মোট ঋণের যা ২৬ শতাংশ। এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ দেখানো হয় ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি বা মোট ঋণের ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, আগের পদ্ধতিতে শ্রেণীকৃত ঋণ হিসাব শুরু হলে খেলাপি ঋণ প্রথমে কিছুটা বাড়বে। এ কারণে ঋণ অবলোপন নীতিমালা শিথিল এবং খেলাপি ঋণ কেনার কোম্পানি গঠন আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে একটি ঋণ অবলোপন করতে হলে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন করতে হবে। ফলে সুযোগ দিলেই এসব ঋণ অবলোপন হয়ে যাবে তেমন নয়। আবার খেলাপি ঋণ বিক্রি করতে চাইলেই অন্যরা কিনে নেবে না। ফলে আদায় জোরদারের বিকল্প নেই। যে কারণে এমডির কর্ম মূল্যায়নে ঋণ আদায়ের লক্ষ্য অর্জন; ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোরতা, অর্থঋণ আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মতো বিষয় সংযুক্ত করা হচ্ছে। অন্যদিকে ঋণ আদায়ে কর্মকর্তাদের উৎসাহ দিতে বিশেষ ভাতা চালু হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২০২১ সালের জুনে কোটিপতি আমানতকারীদের পরিমাণ ছিল ৯৯ হাজার ৯১৮টি। তারপর থেকে চলতি বছরের জুনে একটানা কোটিপতির পরিমাণ বেড়েছে। গত জুন পর্যন্ত বিগত এক বছরে কোটিপতি হিসাবধারীর পরিমাণ কমেছে ৮৫৩৯টি। তথ্যমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোয় জমাকৃত আমানতের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। মোট ১৩ কোটি ৩৪ লাখ ৩৬ হাজার ব্যাংক হিসাবে এ আমানত জমা হয়েছে। দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ সরকারি। বাকি ৮২ দশমিক ৬৯ শতাংশই বেসরকারি খাতের। কোটি টাকার স্থিতি থাকা ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিলেও সে হিসাবগুলোর মধ্যে ব্যক্তির সংখ্যা কত; সে পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও নেই।
দেশের কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, অধিকাংশ ব্যাংকগুলোর কোটি টাকার বেশি হিসাবের মাত্র ৫-৭ শতাংশ ব্যক্তির। বাকি হিসাবগুলো সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি খাতের প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে করপোরেট প্রতিষ্ঠান যেমন রয়েছে; তেমনি রয়েছে স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানও।