ই-পেপার বাংলা কনভার্টার রবিবার ● ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৪ বৈশাখ ১৪৩২
ই-পেপার রবিবার ● ২৭ এপ্রিল ২০২৫
Select Year: 
ব্রেকিং নিউজ:




বাঙ্গালী সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনা
মোঃ কামরুজ্জামান কামরুল
প্রকাশ: রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫, ১:২২ পিএম  (ভিজিটর : ২২৯)

হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত বাংলা ভাষা এবং বাঙ্গালী সংস্কৃতি। বাঙ্গালীর জিবন-বিকাশের ইতিহাস দীর্ঘকালের। সুলতানি আমলে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটে। এই সুলতানি আমলেই বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদের ‘অংকুর’ রোপিত হয়। এই সময়ে বাংলাকে রাজদরবারের ভাষা হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা যায়। এরপর দীর্ঘ পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ শাসনামলে ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’ সূচিত হয়। এর পথপ্রদর্শক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মীর মোশারফ হোসেন প্রমুখ। তবে এসব ঘটনাবলী সমাজের বিত্তবান, অভিজাত ও উঁচু শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সমাজের সকল শ্রেণী এবং পর্যায়কে স্পর্শ করতে না পারলে কোন পরিবর্তনই সুদূরপ্রসারী স্থায়িত্ব পায় না। তাই এসকল পরিবর্তন বাঙ্গালী-মানসকে পরিপুর্ন সন্তুষ্ট করতে পারেনি।  
তাই ১৯৪৭-এর ভারত বিভক্তির পর, ভারতীয় বাঙ্গালী এবং পাকিস্তানী বাঙ্গালী অথবা হিন্দু বাঙ্গালী এবং মুসলমান বাঙ্গালী পরিচিতি চুড়ান্ত হিসেবে স্থায়িত্ব পায়নি। ২৩ বছর অপেক্ষার পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতিসত্তার পুর্নাঙ্গ বিকাশের পথ উন্মুক্ত হলো। ৩০ লক্ষ বাঙ্গালী আর ২ লক্ষ মা-বোনকে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে এই স্বাধীনতা অর্জন করতে।  
দীর্ঘ সংগ্রামের পর, নয় মাসের একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালী অধ্যুষিত পুর্বপাকিস্তান নামক প্রদেশটি বাংলাদেশ নামে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই দীর্ঘ সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধের মূল ভিত্তি ছিল বাংলা ভাষা এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। কিন্তু এই জনপদে বাঙ্গালী ছাড়াও অনেকগুলো জাতিসত্বা এবং ভাষাভাষী মানুষের বসবাস রয়েছে। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালীর ত্যাগ ও আত্নদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টি, তবুও স্বাধীনতা পেয়েছে সকল জাতিসত্বা, সকল ভাষাভাষী, সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ। বাংলা ভাষার ভিত্তিতে দেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে এদেশের নাম বাংলাদেশ। এই মহান স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর এদেশে বসবাসরত সকল ভাষাভাষী, সকল জাতি, সকল সম্প্রদায়কে ধারণ করা বিজয়ী বাঙ্গালী জাতির কর্তব্য। তাই আমাদের জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশী হওয়ার ক্ষেত্রে কারও কার্পন্য থাকার কথা নয়। এ বিষয়ে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের পাশাপাশি বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী ভারতের কয়েকটি প্রদেশেও রয়েছে। তাদের সংখ্যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার চেয়েও বেশী। তারা সংস্কৃতিগতভাবে বাঙ্গালী হলেও জাতীয়তায় ভারতীয়। এমতাবস্থায় আমাদের জাতীয়তা বাঙ্গালী হলে এই জাতীয়তাবাদ একটি খণ্ডিত জাতীয়তাবাদ হয়ে যায়। তাই বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশী বাঙ্গালী পরিচয়ই আমাদের অধিক মর্যাদায় আসীন করবে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে এদেশে বসবাসরত সকল জাতিসত্বা, সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে ধারণ করা সম্ভব। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ মূলতঃ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিকশিত রূপ। একটি সমাজকে বিকশিত হতে হলে বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য নিশ্চিত করতে হবে। একটি বহুত্ববাদী সমাজ গঠনের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় সংহতিকে সুদৃঢ় করতে হবে। 
উগ্র জাতীয়তাবাদ স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয়। জার্মান জাত্যাভিমানের ফলে এডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়েছিলেন। বাঙ্গালী জাত্যাভিমানের ফলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই পাহাড়ে অশান্তি শুরু হয়েছিল। যদিও ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়, কিন্তু পাহাড়ীদের মনে তৈরী হওয়া ক্ষত আজও নিরাময় হয়নি। এক্ষেত্রে বলতেই হয় যে, বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃ-গোষ্ঠি’, ‘সম্প্রদায়’ শব্দগুলি ব্যবহার করে বৈচিত্রপূর্ন সংস্কৃতির ধারক-বাহক কিছু নাগরিকের মর্যাদায় আঘাত করা হয়েছে। এটা উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী মানসিকতার প্রমান। বাঙ্গালাদেশের নাগরিক সবাই সমমর্যাদার। এখানে কেউ ‘উপজাতি’, ‘আদিবাসী,’ ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘সংখ্যালঘু’ নয়। 
বাংলাদেশ যদিও ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন হয়েছে, তথাপিও স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরমুহুর্ত থেকেই রাষ্ট্র হিসেবে তার দায়িত্ব হলো এই স্বাধীন ভূখণ্ডের অধীন সকল নাগরিককে সমমর্যাদায় ধারণ করা। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা। কিন্তু এদেশে বাংলা ভাষার পাশাপাশি আরও অনেকগুলি ভাষাও প্রচলিত রয়েছে। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা করে অন্যান্য ভাষাগুলোকে অমর্যাদা করা হয়েছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠর ভাষা এবং যথেষ্ঠ সমৃদ্ধ হওয়ায় বাংলাকে রাষ্ট্রের দাপ্তরিক ভাষা করা যেত। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের চেতনাও কিন্তু সকল ভাষার মর্যাদা দান করা - কোন ভাষার অবমাননা নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠর ভাষা হলেই যদি রাষ্ট্র ভাষা হয়, তাহলে পৃথিবীব্যাপী প্রচলিত ইংরেজী ভাষা ‘বিশ্বভাষা’ হওয়ার দাবীদার হয়। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে যেমন এদেশের অন্যন্য ধর্মালম্বীদের অমর্যাদা করা হয়েছে, একইভাবে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করে দেশের অন্যান্য ভাষাভাষীদের অমর্যাদা করা হয়েছে।      
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ আরও অনেকে তাঁদের দর্শন ও সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে বাঙ্গালীর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা প্রমান করেছিলেন। রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত রচিত বাঙ্গালীর রাজনৈতিক সাহিত্য, বিভিন্ন ধারার আধ্যাত্মিক দর্শন, লোকজ দার্শনিক লালন শাহ, বাউল ফকির, সুফি সাধক, কত-শত নাটক, যাত্রাপালা, লোকসঙ্গীত এ অঞ্চলের মানুষের মননে বাঙ্গালীত্বের চেতনাকে শানিত করেছে। তবে বিশেষ করে উনিশ শতকের লোকজ দার্শনিক লালন ফকিরের দিকদর্শন বাঙ্গালীর ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা বিকাশে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এরপর ৫২-এর ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক স্বাধীকারের আকাংখাকে আরও এক ধাপ ত্বরান্বিত করেছে। 
একটি জাতির স্বাধীনতা জীবনে একবারই আসে। এই স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করেই জাতীয় চেতনা গড়ে উঠে এবং তা ক্রমশঃ বকশিত হয়। জাতির রাজনৈতিক মুক্তি বা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দেয় রাজনৈতিক শক্তি অর্থাৎ রাজনৈতিক দল। কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করে জাতীয় জীবনে অর্থবহ করে তুলতে হলে জাতীয় চেতনা জনমনে শানিত করতে হয়। আর এই কাজটি করতে হয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে। কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে জাতীয় জীবনে অর্থবহ করতে, মানুষে মানুষে বৈষম্যমুলক সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠি-সম্প্রদায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা।‘   মহৎ চিন্তা, উন্নত জীবন এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড  এক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারে। 
বর্তমানে দেশের স্বাধীনতা – সার্বভৌমত্ব, বাঙ্গালী সংস্কৃতি, অসাম্রদায়িক সমাজব্যবস্থা তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-চেতনা এক গভীর অনিশ্চতার দিকে ধাবিত। দীর্ঘ দিনের ‘অরুচির মহোৎসব’ চর্চার মধ্য দিয়ে পথ চলতে চলতে এ জাতি আজ খাদের কিনার এসে দাঁড়িয়েছে। একদিকে আপদ – অন্যদিকে বিপদ। শুধু রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন করে এই আপদ – বিপদ থেকে পরিত্রান পাওয়া যাবে না। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। রাজনৈতিক সংস্কারের সমান্তরাল সাংস্কৃতিক আন্দোলনই পারে এই মহা সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে।   
বর্তমানে দেশে অনেকগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠন ক্রিয়াশীল রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকের কর্মকান্ড যথেষ্ঠ প্রশংসা পাওয়ার দাবীদার। এসব আদর্শভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে মানুষকে বিনোদন দেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় চেতনাবোধের বার্তা গনমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সরকার এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলসমুহের উচিৎ এ বিষয়ে বিদ্যমান আদর্শভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা প্রদান করা। প্রয়োজনে নতুন নতুন সংগঠন গড়ে ওঠার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জনদের দৃষ্টি আকর্ষন করছি। 
লেখক : মানবাধিকার কর্মি এবং সাবেক ছাত্রনেতা।







সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক : কে.এম. বেলায়েত হোসেন
৪-ডি, মেহেরবা প্লাজা, ৩৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত এবং মনিরামপুর প্রিন্টিং প্রেস ৭৬/এ নয়াপল্টন, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]