বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অধ্যায় হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলার মাটিতে যে নৃশংসতম হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল তা ছিল বিংশ শতাব্দীর মধ্যে অন্যতম গণহত্যা। বাংলাদেশে এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে হানাদার বাহিনী গণহত্যা-নির্যাতন চালায়নি। দীর্ঘ ৯মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতি স্বাধীনতা লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা-নির্যাতন থেকে রক্ষাপায়নি তৎকালীন বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার অন্যতম মহকুমা ঠাকুরগাঁও (বর্তমান জেলা)। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকাসহসারাদেশে গণহত্যাশুরুহওয়ার ২০/২১ দিন মুক্ত থাকার পর ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা ঠাকুরগাঁও শহরে আক্রমণ করে। শুরু করে নির্বিচারে গণহত্যা-নির্যাতন।
পাকিস্তানিদের সহযোগীতায় স্থানীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস, স্থানীয় অবাঙ্গালিরা বাঙ্গালি নিধনে মেতে উঠে। এ গণহত্যা শুধু ঠাকুরগাঁও শহরেই সীমাবদ্ধ ছিলনা, দাবানলের মতো তা ছড়িয়ে পড়ে জেলার সর্বত্র। ১৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও সদর নিয়ন্ত্রণের পর ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা ঠাকুরগাঁওয়ের থানা শহর গুলোর দিকে অগ্রসর হয়। শুরু হয় বিভিন্ন জায়গার নিরীহ মানুষের উপর নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যা।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে ভুল্লী থানার ১৮ নং শুখানপুকুরী ইউনিয়নের জাঠিভাঙ্গা গ্রামের পাথরাজ নদীর তীরে ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম গণহত্যা সংঘটিত করে। এই গণহত্যায় একই দিনে ২০০০-২৫০০ মানুষ শহিদ হন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথম অবস্থায় অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে না গেলেও পরবর্তীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চারদিকে মানুষ মারছে শুনে জগন্নাথপুর, চকহলদি, চন্ডিপুর, সিঙ্গিয়া, আলমপুর, বাসুদেবপুর, গৌরীপুর, মিলনপুর, খামারভোপলা, ঢাবঢুববিল, গড়েয়া, গোপালপুর, ঠেঙ্গামেলী, কালিগঞ্জ, বাহাদুরবাজার, ঝাড়বাড়িসহ, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার বেশ কিছু এলাকা থেকে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ২২ তারিখ সকালে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। জাঠিভাঙ্গায় পৌঁছাতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে যায়।
জাঠিভাঙ্গায় তাদের পথরোধ করে এদেশীয় কিছু বাঙ্গালি, তারা শরণার্থীদের জাঠিভাঙ্গায় রাত্রিযাপন করতে বলে। সন্ধ্যা নেমে আসায় ক্লান্তনারী ও শিশুদের কথা চিন্তা করে তারা রাত্রিযাপনে রাজিহন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় কয়েকজন দোসর রাতের অন্ধকারে যেয়ে ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পে খবর দেয় পাঞ্জাবিদের। ২৩ এপ্রিল সকালে ২ ট্রাক ভর্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জাঠিভাঙ্গায় এসে পৌঁছায়। সাথে ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর স্থানীয় দালালরা।
জাঠিভাঙ্গা গণহত্যার দিন সকাল থেকেই স্থানীয় দালালরা আশেপাশের বাড়ি ঘরে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু পুরুষদের কাউকে ভাঙ্গা পুল মেরামতের কথা বলে , কাউকে বা মিছিলে যোগদানের কথা বলে ডেকে আনে। যারা আসতে চায়নি তাদেরকে জোড় করে নিয়ে আসা হয়। সকলকে পাথরাজ নদীর তীরে একত্রিত করা হয়। এরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলি করা শুরু করে। সেখানে এতো মানুষ ছিল যে সবাই গুলিতে মারা যায়নি।
অনেক মানুষকে গুলিলাগারপরওতারা বেঁচেছিলেন।তাদেরকে স্থানীয় দালালরা, ধারালো অস্ত্র দা, বল্লমদিয়েহত্যাকরে।শহিদ হওয়াপ্রায়সকলমানুষইছিলেনহিন্দু।পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে যাওয়ার পরে স্থানীয় দালালরা পাথরাজ নদীর তীরে গর্ত করে লাশ গুলোকে মাটি চাপা দেয়। অনেক লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
জাঠিভাঙ্গা গণহত্যারদিনপাকিস্তানি সৈন্য ও স্থানীয় দালালরাআশেপাশেরপ্রায়সকলবাড়িঘরেআগুনলাগিয়ে দেয়। সেদিনগ্রামেরপ্রায়সকলপুরুষদের মেরে ফেলা হয়ে ছিল। শুধু তাদের স্ত্রী ও কোলের শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা হয়ে ছিল। স্বামী স্বজনহারা সে সকল বিধবাদের সামান্য যাকিছু অর্থ জিনিসপত্র ছিল স্থানীয় দালালরা সেগুলোওতাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়।পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরহাতেকত শতাংশহিন্দু প্রাণহারিয়েছেনতারপ্রকৃত তথ্য জানানা গেলেও সংখ্যাটি যে ব্যাপক ছিল তার একটি অন্যতম উদাহরণ হলো জাঠিভাঙ্গা গণহত্যা।
এই গণহত্যায় ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার চকহলদি গ্রামের প্রায় ২০০ জন পুরুষ শহিদ হন। তাদের স্মরণে পরবর্তিতে চকহলদি গ্রামের একটি পাড়ার নাম রাখা হয় বিধবা পল্লী। বর্তমানে এই পাড়াতে এখনও বেঁচে আছেন প্রায় ২০ জন বিধবা। যারা বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এসকল বিধবাদের অধিকাংশই এখন শারীরিক ভাবে অসুস্থ, তাদের অনেকেই হাঁটা চলা করতে পারেন না এবং তাদের মধ্যে কয়েক জনের আর্থিক অবস্থা এতটাই করুণ যে, প্রায় দিনই তারা অনাহারে-অর্ধাহরে দিনাতিপাত করেন।
এছাড়াও সদর উপজেলার বাসুদেবপুর, জগন্নাথপুর, সিঙ্গিয়ায় অসংখ্য বিধবা বেঁচে আছেন যাদের অধিকাংশই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও এসকল বিধবাদের ভাগ্যের কোন উন্নয়ন ঘটেনি। ২৬ মার্চ, ২৩ এপ্রিল, ১৬ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে এসকল বিধবাদের জন্য জেলা প্রশাসন কিংবা উপজেলা প্রশাসন থেকে মাঝে মাঝে একটি শাড়ি, কম্বল কিংবা এক বান্ডিল ঢেউ টিন বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেগুলোর অধিকাংশ জিনিসই পৌঁছায়না এসকল বিধবাদের কাছে। তীলে তীলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন এসকল বিধবারা। যাদের স্বজনরা স্বাধীন দেশের জন্য প্রাণ দিলেন, তারাই যেন আজ স্বাধীন দেশের বড় বোঝা।
লেখক:
ফারজানা হক
পিএইচডি গবেষক- ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
প্রভাষক-রত্রাই বোগুলাবাড়ি স্কুল এন্ড কলেজ, বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও