কোনো আইন-আদালত নিয়ম-কানুন বা সন্ধিচুক্তি কিছুই মানছে না ইসরায়েল। যা মন চাচ্ছে তারা তা-ই করছে। যুদ্ধি বিরতির যুক্তি সম্পাদনের পরও তা লঙ্ঘন করে পবিত্র রমজান মাসে রোজাদার মুসলিমদের ওপর গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। একদিনে ফিলিস্তিনের ৪’শ নিরিস্ত্র নারী-শিশুসহ সাধারণ নাগরিককে হত্যা করে ইসরায়েল।
গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় এক পর্যায়ে শহীদ হন হামাসের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা সালাহ আল-বারদাওয়িল। ২৩ মার্চ সকালে এক হামাস কর্মকর্তা ব্রিটেনের একটি প্রভাবশালী গণমাধ্যমকে তার নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। স্থানীয়রা বলছেন, ওই বিমান হামলায় হামাসের রাজনৈতিক দফতরের সদস্য বারদাওয়িল ও তার স্ত্রী নিহত হয়েছেন। চুক্তি লঙ্ঘন করে কেন হঠাৎ করে এমন সন্ত্রাসী আচরণ করতে হবে তার কোনো উত্তর কী আছে বিশ্ববিকেকের কাছে?
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় অভিযান শুরু করে। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, এরপর থেকে গাজায় ৪৯,৫০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
যেসব মানুষের মৃত্যুর তথ্য গণমাধ্যম বা সরকারি কোনো দফতরের নজরে আসেনি সেই সংখ্যা কতো তা আল্লাহ-ই ভালো জানেন। আর দীর্ঘদিন ধরে গাজা উপত্যকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ফলে ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো বিধ্বস্ত হয়ে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। মায়ের কোলে থাকা ছোট্ট ছোট্ট শিশু যখন লাশ হয়ে কবরস্থ হন তখন সাধারণত প্রশ্ন জাগে ফিলিস্তিনি ওই মজলুম মুসলমানদের কী বাঁচার অধিকার নেই?
প্রায় আট দশক ধরে বিনাশের সব আয়োজন জারি রাখা অবরুদ্ধ ‘বধ্যভ‚মি’ ফিলিস্তিনের ছিটমহল গাজায় মৃত্যুই হলো একমাত্র নিশ্চিত অনুষঙ্গ। এই মৃত্যু হতে হলে তো জীবন থাকা বাঞ্ছনীয়। অথচ নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের আদৌ সেই জীবন আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এই মৃত্যু উপত্যকার শীর্ষ কবিদের একজন মুরিদ বারগুতি।
গুলি-বোমা-ক্ষুধা-নির্যাতন আর বিনা চিকিৎসায় অগুনতি মৃত্যু দেখতে অভ্যস্ত মুরিদ বারগুতি লিখেছিলেন ’নিরাশার কালে শুধু মনে রাখি/মৃত্যুর পরও এক জীবন আছে;/ফলে কোনোই সমস্যা নেই আমার।/কিন্তু প্রশ্ন রাখি:/হে খোদা,/মৃত্যুর আগে কি কোনোই জীবন নেই?’ মুরিদ বারগুতির মতো তারই বন্ধু কিংবদন্তিতুল্য ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ লিখে যান, ‘আমার শোক মিছিলে সর্বদাই আমি আগাম হাজির: কে তবে মরে গেল কে?’ এমন সুলভ মৃত্যুর পরিসরেও গত ১৭ মার্চ মধ্যরাতের পর যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ঘুমন্ত গাজাবাসীর ওপর নতুন করে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দখলদার ইসরায়েল, এতে বিস্ময়-ক্ষোভে বিমূঢ় গোটা বিশ্ব।
যুদ্ধবিরতির ‘স্বস্তি’ সঙ্গে নিয়ে ঘর নামের বিধ্বস্ত স্তূপে ফিরে আসা গাজার অনেক বাসিন্দা ওই রাতে ছিলেন গভীর ঘুমে। কেউ কেউ সেহরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেই সময় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান থেকে ফেলা ‘যুক্তরাষ্ট্রের নামাঙ্কিত’ একের পর এক বোমায় হতাহত হতে থাকেন নারী-শিশুসহ সব বয়সী ফিলিস্তিনি। রাতের অন্ধকারে রক্তাক্ত মানুষের আর্তচিৎকার আর আতঙ্কিতদের দিগ্বিদিক ছোটাছুটিতে আবারও ‘দোজখ’ নেমে আসে এ উপত্যকায়। নির্বিচার হামলায় হাতে হাতে সন্তানের ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটতে শুরু করেন অভিভাবকরা।
বিমান হামলা জোরদার করার পর এবার গাজায় স্থল অভিযানের পরিধি বাড়িয়েছে ইসরায়েল। এদিকে দুই/তিন দিনে গাজায় ৪৩০ জনেরও বেশি লোক নিহত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলেছে যে তাদের সৈন্যরা নেতজারিম করিডোর পর্যন্ত চলে গেছে যেটি গাজা উপত্যকাকে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত করেছে। গাজায় নতুন করে হামলার ফলে জানুয়ারি থেকে চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তির কার্যত সমাপ্তি ঘটেছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েল “পূর্ণশক্তিতে যুদ্ধ পুনরায় শুরু করেছে” এবং “এটি কেবল শুরু”। হামাসের দিকে দোষারোপ করে তার বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে জিম্মিদের মুক্তি দিতে হামাস বারবার অস্বীকৃতি জানানোর পাশাপাশি মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর সেনাবাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধে “কঠোর পদক্ষেপ” নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ গাজায় ফিলিস্তিনি ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডা. সাবরিনা দাস হামলা সম্পর্কে বলেন, “এটা খুবই আকস্মিক ছিল... মানসিকভাবে সবাই ভেঙে পড়ে কারণ আমরা বুঝতে পারছিলাম যে এর মধ্য দিয়ে আবার যুদ্ধ শুরু হলো।” ডা. দাস বলেন, নাসার হাসপাতালে তার সহকর্মীরা “সারা রাত জেগে অস্ত্রোপচার করছিলেন” কারণ “আবারও ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে।” আক্রমণ এতটাই আকস্মিক ছিল যে চিকিৎসাকর্মীরা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না এবং তাদের কর্মীসংখ্যাও অপর্যাপ্ত ছিল।
মার্চের শুরুর দিকে ইসরায়েলি জিম্মি এবং ফিলিস্তিনি বন্দি বিনিময়ের পর যুদ্ধবিরতি চুক্তি কীভাবে পরের ধাপে এগিয়ে নেওয়া যায় এ নিয়ে ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। চুক্তির তিনটি ধাপের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা ছয় সপ্তাহ আগে শুরু হওয়ার কথা ছিল যা হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল প্রথম পর্যায়ের মেয়াদ বাড়িয়ে আরও জিম্মিদের মুক্তি দিতে চুক্তির কিছু শর্ত পরিবর্তন করতে চেয়েছিল। চুক্তির দ্বিতীয় ধাপের উদ্দেশ্য ছিল স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের প্রত্যাহার করা।
কিন্তু হামাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কাতার এবং মিশরীয় মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যস্থতায় এই প্রস্তাবিত চুক্তির পরিবর্তনকে প্রত্যাখ্যান করে, এটিকে অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করে। এদিকে জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার দেইর আল বালাহ এলাকায় একটি বিস্ফোরণে তাদের এক কর্মীসহ দুই জনের মৃত্যু হয়েছে।
সরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এই ঘটনার দায় অস্বীকার করে বলেছে, এ বিষয়ে তদন্ত শুরু হতে পারে। ইউএন অফিস ফর প্রজেক্ট সার্ভিসেস (ইউএনওপিএস) বলেছে যে একটি “বিচ্ছিন্ন” অবস্থানে থাকা ভবনটিতে একটি “বিস্ফোরক নিক্ষেপ করা হয়েছে বা গুলি করা হয়েছে”। কী ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে সে সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হতে পারেনি।
লেখক: হাসান আল বান্না, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক