ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিপূর্ণভাবে স্থিতিশীল হয়নি। বরং নির্বাচনের দিনক্ষণ, সংস্কার ও কোন নির্বাচন আগে, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ মতবিরোধসহ বিভিন্ন কারণে রাজনীতিতে কিছুটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। মতবিরোধ, বিরোধিতা ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এ সবের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। তবে আমাদের দেশে দ্বন্দ্ব রূপ নেয় বিরোধিতায়, শেষ হয় শত্রুতায়। সেটা ক্রমেই রাজনীতির মাঠ থেকে ব্যক্তিপর্যায়ে প্রবাহিত হয়। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ও রোডম্যাপ ঘোষণা করা একটি সময়োপযোগী এবং অপরিহার্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সময়মতো নির্বাচন, যা জনগণের মতামতকে প্রতিফলিত করে। তবে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ না হওয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর প্রশাসন, পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা সরে যাচ্ছেন। সেসব জায়গায় নিজস্ব লোকের পদায়ন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যেও এক ধরনের নীরব মনোমালিন্য চলছে।
জানা যায়, রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে মতের মিল থাকলেও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা ইস্যুতে বড় দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। সম্প্রতি তৃণমূল থেকে শুরু করে দল দুটির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য ও কথাবার্তায়ও নানা বিষয়ে বৈরীভাব স্পষ্ট হয়েছে। যেটি প্রকাশ্যে আসে গত আগস্টের মাঝামাঝি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচন আয়োজনে সময় দেওয়া নিয়ে শীর্ষ নেতাদের বাহাস চলছে। তাদের বক্তব্যেই তা ফুটে উঠছে। মূলত ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে বড় দুই দলই যার যার অবস্থান থেকে তৎপরতা চালাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রাহমান মনে করেন, রাজনৈতিক দলের ভিন্নতা থাকতেই হবে। তবে যে উদ্দেশ্যে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে; সেই বৃহত্তর লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ যখন প্রতিপক্ষ ছিল, তখন বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে একটা জোট ছিল। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ না থাকায় এখন ভিন্ন সমীকরণে এই মতপার্থক্য থাকা অস্বাভাবিক নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচন চায় দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলো। কারণ নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশে স্থিতিশীলতা আসবে না। আর জামায়াতে ইসলামী অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে চায়। কারণ, আওয়ামী লীগের আমলে গত ১৬ বছরে দলটি সাংগঠনিকভাবে এগোতে পারেনি। এখন সরকারকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের প্রার্থী ঠিক করাসহ ভিত্তি মজবুত করতে চায়। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে সবাই শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। আগামী দিনেও অন্তর্বর্তী সরকার সহযোগিতা চাইলে আমরা সহযোগিতা করব। তিনি বলেন, দেশে দলও অনেক এবং মত ভিন্ন। তবে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকলেই হবে। রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা কোনো ব্যাপার নয়।
সূত্র আরও জানায়, সরকার ও বিএনপিসহ তার মিত্র দলগুলোর মধ্যে দূরত্বের মূল কারণ হলো নির্বাচনের সুস্পষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা না করা। এছাড়া নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র বিনির্মাণে ঠিক কতটা সংস্কার হবে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা- এসব ইস্যু নিয়ে সরকারের সঙ্গে তাদের সন্দেহ-অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেলে অনেকে ‘মাইনাস টু’ এর বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছে। যদিও বিএনপি বলছে, মাইনাস টু-এর আশা জীবনেও পূরণ হবে না। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে চলতি বছরেই নির্বাচন চায় বিএনপি। তবে এ ক্ষেত্রে অনেকটাই কৌশলী অবস্থান নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি আগে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার ও পরে নির্বাচনের কথা বলছে। এছাড়া আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা, রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে দ্বিমত, ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৭ বছর করার উদ্যোগ নিয়েও বিএনপির আপত্তি রয়েছে। পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নীরব মনোমালিন্য তৈরি হয়েছিল।
এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় দখল ও চাঁদাবাজিসহ নানা ইস্যুতে সরকারের একাধিক উপদেষ্টা ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এখনো অব্যাহত আছে। সব মিলিয়ে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জামায়াত অন্য রাজনৈতিক দলের মতোই একটা দল। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বিরোধের প্রশ্ন আসবে কেন? অনেক নেতা বক্তব্য দিতে পারে, অন্যদের দিকে তাকিয়ে থাকার দরকার হয় না, আমরা আমাদের মতো করে পলিটিক্স করছি। মৌলিক কয়েকটি বিষয়ে সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটা যৌক্তিক সময় তো দিতেই হবে। সর্বশেষ প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভল্যুশন (ঘোষণাপত্র) তৈরি এবং সংবিধান বাতিলসংক্রান্ত বক্তব্য নিয়েও দ্বিমত স্পষ্ট হয়েছে। এখন ঘোষণাপত্র তৈরির দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে শুধু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নয়, গত ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের স্বীকৃতি চায় বিএনপি। ফলে গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরিতেও জটিলতা দেখা দিয়েছে। এছাড়া ছাত্র নেতৃত্বের নতুন দলকে স্বাগত জানালেও এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও মনে করে বিএনপিসহ তার মিত্ররা। সব মিলিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির কিছুটা সন্দেহ-অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তবে সংস্কার হোক আর যাই হোক বিএনপির সমর্থন ছাড়া বা দলটির সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া সরকারের কোনো কাজই সহজ হবে না বলে দেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, সব দলের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্বিঘ্নে একটি নির্বাচন তথা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট আগামী কয়েকদিনের মধ্যে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। আমি মনে করি, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের রোডম্যাপ দেওয়া উচিত হবে। না হলে রাজনৈতিক দলগুলো আবার রাস্তায় নামবে। এতে নতুন সমস্যার মুখে পড়তে হবে সরকারকে। তিনি বলেন, আজ হোক বা কাল হোক নির্বাচন তো দিতেই হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেরিতে নির্বাচন হওয়ার সুযোগ অনেকটাই কমে গেছে। দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আন্তর্জাতিক মহলও নির্বাচন চাইছে। কারণ দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেছে। বিদেশি কোনো বিনিয়োগ নেই, সমঝোতাও হবে না। এ জন্য নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে দেরি হলে দেশে অস্থিরতা বাড়বে। ফলে দ্রুত নির্বাচন হলে দেশে সংকটও কমে আসবে।