রাজধানী সম্প্রসারণে নেয়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রণয়নের আগে খসড়াতে দুই শতাধিক বার এবং প্রজ্ঞাপন জারির পর আরও ১৫৬ বার সংশোধন করেও বাস্তবায়ন উপযোগী করা যায়নি। ভবন নির্মাণে জমির ব্যবহারে এলাকাভিত্তিক তারতম্যকে বৈষম্যমূলক দাবি করে ব্যাপক সমালোচানার মুখে স্থবির হয়ে পড়েছে নতুন নির্মাণ উদ্যোগ। সর্বমহলের সন্তুষ্টির অভাবে সম্প্রতি আবারো ড্যাপ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক। বলা হচ্ছে, ঢাকাকে কীভাবে পরিবেশবান্ধব ও নান্দনিক করা যায় সেজন্য সবাইকে নিয়ে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এটাই বাস্তবায়ন করা হবে।রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ কমাতে ও নাগরিক সেবার মান বাড়ানোসহ রকমারী সব স্বপ্ন দেখিয়ে ২০১০ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক তাদের মহাপরিকল্পনা ‘ড্যাপ’ পাস করে। কার্যক্রমটি ২০০৪ সালে উদ্যোগ নেয়া ‘ডিটেইল্ড এরিয়া প্লান (ড্যাপ)’ তৈরির ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কথা ছিল, প্রয়োগিক বাস্তবতার নিরিখে ২০১৬ সালের আগেই সংশোধিত নতুন আরেকটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে।
ড্যাপ প্রজ্ঞাপনের পর আবাসন ব্যবসায়ীসহ প্রভাবশালীদের চাপে এটি পুনর্বিবেচনা সাপেক্ষে চূড়ান্ত করতে মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি তখন আর ড্যাপ চূড়ান্ত করতে পারেনি। তবে এই সময়ে কমিটি ড্যাপে দুই শতাধিক সংশোধনী এনেছে। এরপর সব মিলিয়ে ১৫৬ বার সংশোধনের পর ২০২২ থেকে ২০৩৫ সাল মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ২০২২ সালের ২২ আগস্ট ড্যাপের গেজেট প্রকাশ হয়। যা একটি বেসরকারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের তদারকিতে সম্পন্ন করায় বৃহৎ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বার্থরক্ষা করেছে দাবি করে সমালোচনার মুখে পড়ে। বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে খোদ ‘রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ রিহ্যাবসহ বিভিন্ন মহল থেকে এটিকে বাতিল ও সংশোধনের প্রস্তাব আসে। ফলে সম্প্রতি আবারো ড্যাপ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায়ীসহ অনেকের আপত্তির কারণে ১৫৬ বার সংশোধন হয়েছে। এখন আবারো সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে গেজেটকৃত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-২০৩৫) কিছু সংশোধনী ও সংযোজনী গেজেট আকারে প্রকাশের পূর্বে জনসাধারণের মতামত গ্রহণের জন্য সংশোধনী খসড়া রাজউকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য সবাইকে অনুরোধ করেছে রাজউক।
তাদের মতে, ২০২২ সালের ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতো ড্যাপ বাংলাতে গেজেটভুক্ত হয়। সে সময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এর ওপর মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ পান। মতামতগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে খসড়া ড্যাপের বিজ্ঞানভিত্তিক ও যৌক্তিক কিছু সংশোধন আনা হয়। ২০১০ সালে পাস হওয়া ড্যাপের মেয়াদ ছিল ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কথা ছিল, ২০১৬ সালের মধ্যে সংশোধিত নতুন আরেকটি ড্যাপ প্রণয়ন করা হবে, তখন আর আগের ড্যাপের প্রয়োজন থাকবে না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নতুন ড্যাপ করা সম্ভব হয়নি। এমন অবস্থায় ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ড্যাপের মেয়াদ ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এরপর ড্যাপের মেয়াদ বাড়িয়ে নতুন করে ২০২২ সালে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এতে রাজধানী ঢাকা পুরোপুরি বাসযোগ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে বলে মনে করেছিলেন নগর বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু নানা জটিলতায় এখন পর্যন্ত ড্যাপ বাস্তবায়ন হয়নি। যে কারণে এখন আবারো সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে প্রকাশ করা ড্যাপের নতুন গেজেট (২০২২-২০৩৫) অনুযায়ী ভবন নির্মাণে ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও), রাস্তার প্রশস্ততা, ভবনের উচ্চতাসহ নানা বিষয়ে কড়াকড়ি শর্ত থাকায় ঢাকায় ভবন নির্মাণ-বাণিজ্যে ধস নামে। ওই গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পর অন্যান্য সময়ের তুলনায় রাজউক থেকে ভবনের নকশা অনুমোদনের হার অর্ধেক নেমে আসে। পরে রিহ্যাবসহ ভবন নির্মাতাদের দাবি ও সমালোচনার মুখে ২০২৩ সালের সংশোধিত ড্যাপে কিছুটা ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) সুবিধা বাড়ানো ও সামনের রাস্তার প্রশস্ততার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়। তবে এতেও নকশা অনুমোদনের সংখ্যা বাড়েনি। অভিযোগ রয়েছে, ড্যাপ (২০২২-৩৫) প্রণয়নের আগে ‘ঢাকা কাঠামো পরিকল্পনা’ ২০১৬ সালে প্রণয়ন করা হলেও তা গ্যাজেটভুক্ত না করে আইনি ব্যত্যয় ঘটিয়ে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করে ২০২২ সালে এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) গেজেট করা হয়। ফলে এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) বেআইনি প্রক্রিয়ায় প্রণীত হয়েছে। প্রকল্পে বন্যা প্রবাহ অঞ্চলের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে এবং কৃষি জমিতে অবাধ নগরায়ণের সুযোগ দিয়ে এই পরিকল্পনা মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে বলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। ফলে এসব বিষয়ে সংশোধন জরুরি বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। তবে আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, ড্যাপ প্রজ্ঞাপন জারির পর আবাসন খাতে ব্যাপক মাত্রায় স্থবিরতা নেমেছে। আগামীতে এই সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। বিগত সরকার প্রণীত বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপের (২০২২-২০৩৫) কারণে খালবিল, জলাশয় ও কৃষিজমি দ্রুতগতিতে হ্রাস পাবে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর হবে। তাছাড়া, এই প্রকল্প ঢাকাকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে নয় বরং এই প্রকল্প তৈরি হয়েছিল কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের সুবিধাভোগের জন্য। তাই এই ড্যাপ বাদ দিয়ে বর্তমান সরকারকে নতুন প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান তাদের। নগর পরিকল্পনাবিদ মাহফুজা আক্তার বলেন, ঢাকাকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে কোনো না কোনো প্ল্যান তো নিশ্চয়ই থাকবে। নয়তো শহরের উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। ড্যাপের বিষয়ে অনেক ধরনের আলোচনা হচ্ছে। তবে বাতিল হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে সংশোধন হতে পারে। সেটা নিশ্চয়ই হবে।
রিহ্যাবের সভাপতি ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, একটি সুন্দর ও সময়োপযোগী ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ কে উপেক্ষা এবং মাস্টার প্ল্যান-২০১০ অন্যায়ভাবে রহিত করা হয়। আবাসন খাত যাতে কুক্ষিগত করা যায় এবং বিগত সরকারের মদদপুষ্ট একটি স্বার্থান্বেষী মহলকে খুশি করতে কিছু অসাধু কর্মকর্তা এ কাজ করেন। এই ড্যাপ প্রজ্ঞাপন জারির পর আবাসন খাতে ব্যাপক মাত্রায় স্থবিরতা নেমে এসেছে। আমরা চাই না পূর্বের সরকার প্রণীত বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপের (২০২২-২০৩৫) কারণে এই তিলে তিলে গড়ে ওঠা আবাসন শিল্প বন্ধ হয়ে যাক। ফলে এটিকে বাদ দেয়াই ভালো।
রাজধানী সম্প্রসারণে নেয়া ড্যাপ মহাপরিকল্পনা ১৫৬ বার সংশোধন করা হয়েছে উল্লেখ করে রাজউকের চেয়ারম্যান ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, এটিকে বাস্তবসম্মত করার কাজ চলছে। প্রয়োজনে আবারো সংশোধন করা যেতে পারে। ভবিষ্যতে যেসব প্লট রাজউক দেবে সেখানে ২০ কাঠার নিচে বরাদ্দ করা হবে না উল্লেখ করে তিনি জানান, সেখানে এক বিঘা প্লট দেয়া হবে এবং সেখানে জানতে চাওয়া হবে কয়টা ফ্ল্যাট করা হচ্ছে। এছাড়া পরিবেশবান্ধব ও নান্দনিক ঢাকাকে কীভাবে করা যায় সেজন্য সবাইকে নিয়ে আমরা একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছি। আশা করছি এটা ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন করা হবে। তবে এটা এক দিনে বাস্তবায়ন করা যাবে না।