চট্টগ্রাম মহানগরের নালাগুলো অরক্ষিত থাকায় একের পর এক অস্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে। এভাবে নালায় পড়ে গত ৪ বছরে ১২ জনের মৃত্য হয়েছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নগরীর চকবাজার এলাকায় নালায় পড়ে যায় ছয়মাসের শিশুসহ এক মা। মা বেঁচে ফিরলেও নিখোঁজ ছিল ছয় মাসের শিশু সেহরিশ। পরে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়।
খবর নিয়ে গেছে, খাল-নালায় পড়ে বেঘোরে মৃত্যু বা নিখোঁজের সঠিক তালিক নেই কোন সংস্থার কাছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম নগরীর খোলা নালায়-খালে পড়ে অন্তত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে দু’জনের। আর আহতের সংখ্যা অনেক। এত প্রাণহানির পরও এসব নিয়ে ‘দৃষ্টি’ দেয়ার গরজ নেই কর্তৃপক্ষের।
নগরবাসী বলছেন, নগরীর অধিকাংশ খালের দুই পাশে নিরাপত্তা বেস্টনি না থাকা, নালার ওপর স্লাব না থাকায় খাল ও নালাগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। যে কারণে মৃত্যুফাঁদে আটকে প্রাণ হারাচ্ছে সেহেরিশরা। এদিকে নালায় পড়ে বেঘোরে প্রাণ হারানোর মতো এমন অমানবিক মৃত্যু খোদ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামে ফি বছর ঘটে চললেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন মাথাব্যথা নেই। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ নগরবাসীর।
চকবাজারের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, শুধু ড্রেনগুলো নয়, পুরো শহরের নালা-খালই এখনো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। এত প্রাণ যাওয়ার পরও কারও কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেই। কেউ মারা গেলে কয়েকদিন বেশ হাঁক-ডাক চলে। এরপর চাপা পড়ে যায় নিরাপদ নগরীর গড়ার দাবি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক এড. আখতার কবির চৌধুরী বলেন, নগরীর জলাবদ্ধতা একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। এ থেকে কবে মুক্তি মিলবে সেটি আর বলার প্রয়োজন মনে করছি না। তবে নগরবাসীকে এসব খালা-নালের মৃত্যুর ফাঁদ থেকে যাদের নিরাপত্তা দেয়ার কথা, এতো মৃত্যুর পরও তাদের বোধোদয় হয়নি।
তাদের কাছে পিঁপড়ার চেয়েও নাগরিকদের জীবন মূল্যহীন। বর্ষার সময় বিপদজ্জনক নালা-খালগুলোকে তারা চিহ্নিত করে লাল পতাকা টাঙিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু বহুবার এসব বলার পরও কোন গরজ নেই। আছে শুধু একজন-আরেকজনকে দোষারোপ। এতে তারা তাদের ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দ্রæত ব্যবস্থা না নিলে তাদের এমন অবহেলার খেসারত আরও দিতে হবে।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট। নগরীর মুরাদপুরে পা পিছলে নালায় পড়ে যান ব্যবসায়ী সালেহ আহমদ। মুহূর্তের মধ্যেই স্রোতে তলিয়ে যান তিনি। প্রায় চার বছর কেটে যাচ্ছে, কিন্তু আজও মেলেনি তার দেহাংশ। সালেহ আহমদের নালায় পড়ে যাওয়ার সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজ সারাদেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছিল। নিশ্চিত মৃত্যুর পৃথিবীতে কিছু কিছু মৃত্যু বড় বেশি ছাপ ফেলে যায়।
হৃদয়ে দাগ রেখে যায় প্রিয়জনের। তেমনি এক মৃত্যুর কথা এখনো মনে দাগ লেগে আছে নগরবাসীর। সালেহ আহমদের মৃত্যুর ঠিক এক মাস না যেতে একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরীর আগ্রাবাদে অরক্ষিত নালায় পড়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার কথা হয়তো এখনো ভুলেনি কেউ। যেই মৃত্যু সেদিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছিল সেই সময়ে।
ব্যবসায়ী সালেহ আহমদ ও শিক্ষার্থী সাদিয়ার মৃত্যুর পর খাল নালার দু’পাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরির পাশাপাশি উন্মুক্ত নালাগুলোতে সংস্কারের দাবি ওঠার পর কিছুটা নড়ে বসে সিটি কর্পোরেশন। সেই সময়ে খোলা নালার পাশে বেস্টনি দেয়ার ব্যাপারে তৎকালীন মেয়র সরব হলেও সেটি বাস্তবে রূপ পায়নি।
তবে এ পর্যন্ত নগরীর নালা-খাল কিংবা ড্রেনে পড়ে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে, তার সঠিক কোন পরিসংখ্যা নেই কারও কাছে। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে অন্তত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দুইজনের মরদেহের খোঁজ আজও মেলেনি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে খাল-নালায় পড়ে ডুবে মারা যান পাঁচজন। ২০২২ সালে একজন, ২০২৩ সালে তিনজন, ২০২৪ সালে নিখোঁজ ও মারা যান চারজন। আর গতকাল নগরীর চকবাজারে নিখোঁজ হন ছয়মাসের শিশু সেহরিশ।