যশোরের মণিরামপুরের অভিশপ্ত ভবদহে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। মণিরামপুর উপজেলার কুলটিয়া,হরিদাসকাটি,নেহালপুর, মনোহরপুর, ঢাকুরিয়া, দূর্বাডাঙ্গা,খানপুর ইউনিয়নসহ ভবদহ অধ্যুষিত বিলাঞ্চলের দিগন্তজোড়া বিস্তীর্ণ মাঠে এখন হাওয়ায় দুলছে সোনালী ধানের ক্ষেত। চোখ জুড়ানো সোনালী ধানের শীষের সাথে জড়িয়ে আছে জলাবদ্ধ ভবদহ অঞ্চলের কৃষকের রঙিন স্বপ্ন! ভবদহ অঞ্চলের সবচেয়ে জলাবদ্ধতার শিকার বিল বোঁকড় ও বিল কেদারিয়া, আড়পাতার বিল, হরিণার বিল,সামন্দডাঙ্গার বিল, বিল শালিখাসহ আশপাশের জলাবদ্ধ বিলাঞ্চল থেকে সেচপাম্পের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন করে এবার বোরো ধানের আবাদ করে কাঙ্খিত ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে কৃষকেরা।
উপযুক্ত আবহাওয়া ও চাষাবাদ ব্যবস্থাপনায় ভবদহ বিলাঞ্চলসহ সারা উপজেলা জুড়ে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে অভিশপ্ত ভবদহে চলছে ফসল উৎসব। পাকা ধান কেটে ঘরে তুলতে নারী-পুরুষ সমানতালে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। বাম্পার ফলন পেয়ে কৃষকের মুখে আনন্দের হাসি!
উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে মণিরামপুর উপজেলায় বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ২৮ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমি। আর আবাদ হয়েছে ২৬ হাজার ৯০০হেক্টর জমিতে। তন্মধ্যে হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদ হয়েছে ৫ হাজার ৭১৫ হেক্টর ও উফসি জাতের ধানের চাষ হয়েছে ২১ হাজার ১৮৫ হেক্টর জমিতে। যা বিগত বছরের তুলনায় অনধিক। হরিণার বিলে বাঁধ ভেঙে ১৪৪ হেক্টর জমির বোরো ধানের ক্ষতিসাধন হলেও ১৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার বিস্তীর্ণ মাঠে গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বোরো ধানের আশাতীত চাষাবাদ হয়েছে।
সরেজমিন গত ১৩ ও ১৪ এপ্রিল উপজেলার কুলটিয়া ও হরিদাসকাটি এলাকার বিলবোকড়, ও সামন্দডাঙ্গার বিলে যেয়ে বোরো ধানের সোনালী ক্ষেত দেখে মন জুড়িয়ে যায়। রোদের আলোয় ও বৈশাখী হাওয়ায় সোনালী ধানের শীষ দোল খাচ্ছে আর রোদে ঝিকমিক করছে। সে এক অন্য রকম ভাল লাগা। সামন্দডাঙ্গা বিলের বোরো চাষী উপজেলার ভোমরদহ গ্রামের মিজানুর রহমান তার নিজস্ব সেচযন্ত্র গভীর নলকুপের আওতায় বিশ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন।
তিনি জানান, স্থানীয়রা উদ্যোগ নিয়ে বিল থেকে সেচপাম্পের মাধ্যমে পানি সেচে বোরো ধান লাগিয়েছে। উপযুক্ত আবহাওয়া, সেচ সুবিধা , সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ঝড়বৃষ্টির কবলে পড়ে ধানের ক্ষতিসাধনের শঙ্কায় পাকা ধান কেটে বাড়ী এনে ঝাড়াই-মাড়াইয়ের কাজে তাই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঢাকুরিয়া গ্রামের আবু জিহাদ ও জালাল উদ্দীন একই বিলে ধান আবাদ করে ভাল ফলনের আশা করছেন বলে জানান। এবার কেমন ফলন হয়েছে জানতে চাইলে উপজেলার শ্যামকূড় ইউনিয়নের হালসা গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম জানান, তিন বিঘা জমিতে বোরো ধান লাগিয়েছি। ১০ কাঠা জমির ধান কেটে ঝাড়াই করে কাঠা প্রতি দুইমন হারে ফলন পেয়েছি।
বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্যোগে চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকদের প্রনোদনা হিসেবে ৪ হাজার ১’শ৫৫ জন চাষীকে ২ কেজি হারে হাইব্রিড জাতের ধানের বীজ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪ হাজার ৫’শ কৃষককে উফসি জাতের ধান আবাদের জন্য প্রনোদনা সহায়তার অংশ হিসেবে বিনামূল্যে উফসি জাতের ৫ কেজি ধান, ১০ কেজি হারে ডিওপি ও ১০ কেজি হারে এমওপি সার বিতরণ করা হয়েছে। সেচ মালিকদের খামখেয়ালী সেচের টাকা ধার্য করায় অতিরিক্ত খরচ, সার ও কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত বাজারদর, কলের লাঙ্গল দিয়ে জমি প্রস্তুতিতেও অতিরিক্ত ব্যয় এবং উচ্চমূল্য দিয়ে কৃষি শ্রমিক নিয়ে ধান আবাদ করতে কৃষকদের বাড়তি খরচ গুনতে হয় এমন নানাবিধ ভোগান্তির কারণে কৃষকেরা ধানের আবাদ থেকে ইতিপূর্বে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ছিলেন। কিন্তু খোলাবাজারে ধানের বাজারদর তুলনায় সন্তোষজনক হওয়ায় চাষীরা ধানের বাজার দর নিয়ে খুবই খুশি। তা ছাড়া ধানের খড় ও বিচালীর বাজারদরও বেশ চড়া থাকায় অন্যান্য ফসলের আবাদ চেয়ে ধানের আবাদ এখন অনেকাটা লাভজনক জেনে কৃষকরা বোরো ধান আবাদে বেশ ঝুঁকে পড়েছে।
উপজেলার পূর্বাঞ্চলের ভবদহ অ্যধুষিত জলাবদ্ধ এলাকায় প্রায় ৩হাজার হেক্টর জমিতে এবারও বোরো ধান আবাদে বেশ অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কিন্তু এলাকার ভুক্তভোগী কৃষকরা নিজেদের উদ্যোগে সেচযন্ত্র দিয়ে বিলের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করায় জলাবদ্ধ কিছু কিছু এলাকায় বোরো ধান আবাদ সম্ভব হয়েছে।
কুলটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখর চন্দ্র রায় বলেন, ভবদহে ২০টি সেচযন্ত্র বসিয়ে পানি সেচ দেওয়ার সুফল এলাকার কৃষকরা এখন ভোগ করছে। তাই এ বছর জলাবদ্ধ ভবদহ এলাকায় অনেক জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ভবদহের করাল গ্রাসে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা তাই বোরো ধানের চাষ করতে পেরে খুশির জোয়ারে ভাসছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসার মোছাঃ মাহমুদা আকতার জানান, চলতি বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় কৃষকরা আশাতীত জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছেন। ধানের বাজার দর ভাল হওয়ায় কৃষকেরা ধান চাষে ঝুকছে। ফলে অত্র উপজেলায় এবার আশাতীত জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ফলন ও বেশ ভাল হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসের সংশ্লিষ্ট এলাকার কর্মকর্তাদেরকে সরেজমিন যেয়ে কৃষকদের যথাযথ পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা প্রদানের ফলে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে তিনি দাবী করেন।