
হিজরী সন হইতে বাংলা সনের উৎপত্তি, হিজরী সনের প্রবর্তন করেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা:)। ২য় খলিফা হযরত ওমর (রা:) ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে আনুষ্ঠানিক ভাবে তা চালু করেন। মহানবী (সাঃ) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ২০ সেপ্টেম্বর মক্কা হতে মদিনার হিজরত করেন। তখন আরব দেশে বহুবিধ সনের প্রচলন ছিল। হস্তিসন,বন্যা সন,হবুতিসন,খসরু সন,লুইসন,আমউল ফজুর,আমউল ফাতেহ্ সন যা আঞ্চলিক ও গোষ্ঠী ভিত্তিক। হিজরী সন চালু হলে তাহা হয় সার্বজনীন। খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে ১৫৫৬খ্রি: বাদশাহ আকবরের নির্দেশে তারই নবরত্মের পন্ডিত ফতেহ উল্লাহ্ সিরাজী সৌর বর্ষকে কেন্দ্র করে হিজরী সনকে ভিত্তি ধরে ৯৬৩ হিজরী হতে ফসলী সন চালু করেন। তাহাই পরবর্তীতে বাংলা সন হিসাবে অভিহিত ও পরিচালিত হয়ে আসছে। শুরুতে বাংলা মাসের নাম ছিল- কারওয়াদিন,আরিদিভিহিসু,খারদাদ,তীর,আমরারদাদ, শাহরিয়ার,মিহির,আবান,আয়ুর ইত্যাদি উচ্চারন করতে কঠিন বিধায় শকাব্দ সন হতে বর্তমান বাংলা মাস গুলো চালু করা হয়। দিন গুলোর ও পৃথক নাম ছিল, পরে সম্রাট শাহজাহান এ প্রথা বিলুপ্ত করেন। সপ্তাহে ৭টি দিনের জন্য ৭টি গ্রহের নামানুসারে ৭টি নাম করণ করেন। রবি (সান), সোম (মুন), মংগল (মার্স), বুধ (মার্কারী), বৃহস্পতি (জুপিটার), শুক্র (ভেনাস), শনি (সেটার্ন) গ্রহ থেকে। বাংলা মাসের নামকরন করা হয় নক্ষত্রের নামানুসারে। বিশাখা নক্ষত্র থৈকে বৈশাখ মাস, জ্যৈষ্ঠ নক্ষত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস, আষাঢ় নক্ষত্র থেকে আষাঢ় মাস, শ্রাবনা নক্ষত্র থেকে শ্রাবন মাস ইত্যাদি নামকরণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, স¤্রাট আকবর যখন দিল্লির সিংহাসনে আরোহন করেন তখন উপমহাদেশে শকাব্দ, কলাব্দ, বিক্রমাব্দ, সংবৎ, জালালী সন, সিকান্দর সন ইত্যাদি বিভিন্ন সনের প্রচলন ছিল এবং এসব অব্দের কোনটিরই সর্ব ভারতীয় স্বীকৃতি ছিলনা। এগুলো ছিল অঞ্চল ভিত্তিক।
বিশ্বজগৎ সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই মহান স্রষ্টা সন গননার সুচনা করেছেন। মানুষের যিনি স্রষ্টা, আদি কাল থেকে তিনি সনের সৃষ্টি করেছেন। দিন, ক্ষন, মাস, বছর ইত্যাদি গননার সূত্রপাত হয়েছে।
বিশ্ব সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই মহান আল্লাহ বলেন, "আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট বছর গননার মাস বারটি। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।" (সুরা তাওবা আয়াত-৩৬)
বান্দার প্রতি আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে দিন ও মাস গণনা একটি গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত। এ নেয়ামত ও তার তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য মহান রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন "তিনি উষার উন্মেস ঘটান, তিনি বিশ্রামের জন্য রাত্রি ও গননার জন্য সূর্য ও চন্দ্র সৃষ্টি করেছেন। এসবই পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞানের নিরুপন।" (সুরা আনাম আয়াত-৯৬)
আল্লাহ আরও বলেন "তিনি সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোর্তিময় করেছেন এবং এর মনজিল নির্দিষ্ট করেছেন। যাতে তোমরা বছর গননা ও সময়ের হিসাব জানতেপার। আল্লাহ কোন কিছুই নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এ সমস্ত নির্দশন বিষদ ভাবে বর্ণনা করেন। দিন ও রাত্রি পরিবর্তনে আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে আল্লাহ যাহা কিছু সৃষ্টি করেছে, সে সব কিছুর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে মুত্তাকিদের জন্য"। (সুরা ইউনুস আয়াত-৫৬) দিন-রাত্রি, মাস-বছর ঋতু তিথির হিসাব সংরক্ষন সহজতর হয়েছে এবং পৃথিবীতে সকল সৃষ্টির ধারা যথারীতি অব্যাহত রয়েছে-আল্লাহ বলেন: "সূর্য ও চন্দ্র পরিক্রম করে নির্ধারিত কক্ষ পথে।" (সুরা আর রহমান আয়াত-৫)।
আল্লাহ রাত্র ও দিনের নিদর্শন দ্বয়ের বর্ণনা দিয়ে বলেন: "আমি রাত ও দিনকে করেছি দুটি নিদর্শন। রাত্রির নিদর্শন অপসারিত অর্থাৎ আধারে আচ্ছাদিত করেছি এবং দিনের নিদর্শনকে আলোক প্রদ করেছি-যাতে তোমরা তোেেমদর প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার। এবং যাতে তোমরা বর্ষ, সংখ্যা, হিসাব নিরূপন করতে পার। (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-১২) দিন ও রাত্রি, চন্দ্র ও সূর্যের নির্দিষ্ট আবর্তন তার গুঢ় তাৎপর্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন: "তাদের জন্য এক নিদর্শন রাত্রি, তাকে আমি দিবালোক অপসারিত করি, সকল কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং সূর্য্য তার নির্দিষ্ট কক্ষে ভ্রমন করে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। এটা পরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এবং চন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ করেছি বিভিন্ন মনজিল।
অবশেষে তা শুষ্ক বক্র পুরাতন খেজুর শাখার আকার ধারন করে। সূর্য্যরে পক্ষে সম্ভব নয় চন্দ্রের নাগাল পাওয়া এবং রজনীর সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা এবং প্রত্যেক নিজ নিজ কক্ষ পথে সন্তরন করে"। (সূরা ইয়াসীন, আয়াত- ৩৭-৪০)
“জীর্ন বয়সকে পিছনেই ঠেলে দুরন্ত বৈশাখ আজ
নেমেছে পৃথিবীর অলিতে গলিতে বৈশাখী কারুকাজ।”
# বাংলা নববর্ষকে কবি সাহিত্যিকগন বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে দেখেছেন।
# মাইকেল মধু সুদন দত্তের মতে, “উত্থান ও পতনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।”
# কবি গুরু রবী ঠাকুরের মতে, “বাংলা নববর্ষ বৈশাখের প্রচন্ড তাপদাহ সত্ত্বেও উৎসবের আনন্দে প্রানে বন্যায় আমাদের হৃদয়ে ঝড় তোলে।”
# কবি নজরুলের দৃষ্টিতে, “অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লবী চেতনা সৃষ্টি করে।”
# কবি গোলাম মোস্তফার মতে, “দুঃখ, রোগ-শোক ভুলে সুখ সমৃদ্ধির দিকে আমরা ধাবিত হই।”
# কবি ফররুখ আহম্মেদের দৃষ্টিতে, “বৈশাখকে বিপ্লবের প্রতিক হিসাবে দেখেছেন। আপোষহীন স্বত্ব হিসাবে।”
# জীবনানন্দ দাসের দৃষ্টিতে, “বৈশাখকে দেখেছেন শুভ্রতার প্রতিক হিসাবে।" ফুলে ফলে ভরপুর সবুজের সমারোহ রূপে। চল্লিশে দশক ছিল যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক চেতনার পরিবর্তন। জাগরন ও অস্তিরতার সময়।”
# এরপর আবির্ভূত হলেন সামসুর রহমান, আল মামুন, হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, মাহফুজ উল্লাহ, মনিরুজ্জামান, সৈয়দ সামসুল হক, শহীদ কাদরী ও আজিজুল হক অ প্রমুখ। তারা পুরাতনকে পিছনে ঠেলে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে বলেছেন।
পরবর্তীতে আঃ মান্নান, সৈয়দ রফিক আজাদ, আফজাল চৌধুরী, ওমর আলী, নির্মলেন্দু গুন, মহাদেব সাহা, আবুল হাছান। তাদের সৃষ্টিতে বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ "বৈশাখ মানেই যেন জীবনের জন্য ভালবাসা, ভালবাসার জন্য জীবন।
বিংশ শতাব্দীতে কবি আঃ হাই শিকদার, রেজা উদ্দিন, স্ট্যালিন, খসরু পারভেজ তাদের দৃষ্টিতে বাংলা নববর্ষকে দেখেছেন “বৈশাখ শুধু আমার নয়, আমাদের নয়, সবার, সকলের।” কবি বেনজীরে দৃষ্টিতে, “বৈশাখ মানে বিপ্লবী চেতনা।” এক বিংশ শতাব্দীর কবিদের চিন্তা চেতনার বৈশাখ দীনতা, হীনতা, জীর্নতা, নীচতা থেকে উন্নতির পরে শক্তি ও সাহস যোগাইয়াছেন। বাংলাদেশে উপজাতিরা ১লা বৈশাখের পরিবর্তে পালন করে "বৈসাবী" উৎসব, তারা ৩ দিন এ উৎসব পালন করে। বাংলা বছরের শেষ ২ দিন ও নববর্ষের প্রথম দিন।
১ম দিন: ঘর বাড়ী, আঙিনা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে। ফুল দিয়ে সাজানো হয়। নদীতে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে পুরানো বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানান হয়।
২য় দিন: প্রতিটি বাড়ীতে মজার খাবার তৈরি করা হয়। কমপক্ষে ২০ ধরনের সবজি দিয়ে খাবার তৈরি করা হয়। তাকে বলে "পাজন"।
৩য় দিন: এই দিনে দল বেধে মন্দিরে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। এই দিনকে বলা হয় নয় গেন্যা, পেজ্যা।
বৈসাবীর নামকরণ করা হয় নি¤œ বর্নিত উপজাতিদের নববর্ষের নামকরণ হতে।
ত্রিপুরা ভাষায়- বৈসুক।
চাকমা ভাষায়- বিজু।
মারমা ভাষায়- সাংগ্রাই।
রাখাইন ভাষায়- সাংগ্রে
তঞ্চঙ্গাঁ ভাষায়- বিষু।
অহমিয়া ভাষায়- বিহু।
খেলা: নাদের বলী, ফোর, পুত্তি, তুমুরো খেলা।
বিভিন্ন দেশে নববর্ষ বিভিন্ন নামে অভিহিত তা নি¤েœ বর্নিত করা হলো:-
দেশ নববর্ষ
ইরান, আফগানিস্তান- নওরুজ
আফ্রিকা- ওডানডি
প্যান সিলভানিয়া
ফিলাডেলকিয়া- ইয়োরোবা
কম্বোডিয়া- ১১ সেপ্টেম্বর
চিন- ১৪ এপ্রিল
দঃ কোরিয়া- সিউল্লাল
থাইল্যান্ড- সংবান।
মধ্যপ্রাচ্যে- হিজরী ১লা মহরম।
বেলজিয়াম- খ্রিষ্টাব্দের নববর্ষের পরিবারের সকল রঙ্গিন খামে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে
চিঠি লিখেন
জাপান- ইংরেজী নববর্ষে বাড়ীর প্রবেশ পথে রসি জুলিয়ে রাখে হাসতে হাসতে
বাড়ীতে প্রবেশ করে।
পর্তুগাল- রাত ১২ টায় ১২ টি করে আঙ্গুর খায়।
দঃ আফ্রিকা- শয়তান দূর্ভাগ্যে, দুর করার জন্য খড়কুটা দিয়ে শয়তান বানিয়ে পোড়ে।
# ১৩২৫ বঙ্গাব্দে মাইকেল মধুসুদন দত্তের বন্ধু/ রাজ নারায়ন বসু সর্বপ্রথম কলকাতায় বাংলা নববর্ষের উৎসব চালু করেন।
# অতঃপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩২৬ বঙ্গাব্দে বিশ্ব ভারতীতে বাংলা নববর্ষের প্রচলন শুরু করেন।
# পাকিস্তান আমলে ১৯৬৩ সন পর্যন্ত পাঁক সরকার বাংলা নববর্ষের উৎসব পালনে নিষিদ্ধ করেন।
# ১৯৬৪ সালে ঢাকা শহরে সর্বপ্রথম পারিবারিক পরিবেশে করি জাহানারা আরজুর বাসায় তৎ কালিন তরুন কবি হাসান হাবিজুর রহমান বাংলা নববর্ষের উৎসব পালন করেন। অতঃপর ১৯৬৫ সন হইতে রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষের উৎসব চালু হয়। অর্থাৎ মোদ্দা কথা হইল এই যে, ১লা বৈশাখ বাঙালীদের জন্য সার্বজনীন উৎসব। হিন্দু, মুসলীম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই এদিনটি উৎসাহ উদ্দীপনা ও আনন্দে এই দিনটি পালন করে। সেহেতু বাংলা সন, জাতীয় সন।
লেখক: সাবেক সম্পাদক, নরসিংদী জেলা আইনজীবী সমিতি।