একটি দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা জন্ম সনদ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যা অপরিবর্তনীয় । সংবিধানের পেনাল কোড এ ১২৩এর 'ক' ধারায় স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রের পরিবর্তন প্রচেষ্টা রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধ। কোন আইন বা আদালত এটি পরিবর্তন করতে পারে না। পার্লামেন্টের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাধিক্যও পারেনা পরিবর্তন করতে। সংবিধান এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আলাদা। সংবিধান সংশোধন অথবা বিয়োজন করা যেতে পারে। পার্লামেন্টের দুইতৃতীয় অংশ মেজরিটির মাধ্যমে। সংবিধান প্রশ্নে সাব অর্ডিনেট অফিস অর্ডারও সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। তারপরেও আমাদের মহান '৭১-র সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সনদ এবং সংবিধান পরিবর্তনের অপচেষ্টা কেন? ১৯৭১সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকে মুছে ফেলে তার উপর ২০২৪ সালের কথিত স্বাধীনতা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য? আমি আপনাদের কাছে এই প্রশ্ন রেখে গেলাম।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পরবর্তী যুদ্ধপ্রস্তুতি, এর মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্ত স্বাধীন দেশে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রথম বছর—এ তিন পর্যায় ও ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’-এর যে গুরুত্ব ও ভ‚মিকা, তা শুধু অসামান্যই নয়—বস্তুত এটিই ছিল ওই তিন সময়ের জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল পথনির্দেশক, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি।
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর নতুন সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এটিই ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান, যেটিকে পরবর্তী সময়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে মূল সংবিধানের তফসিল হিসেবেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এটিই হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান, যার আওতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছর নয় মাস এ দেশ পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয় নিয়ে গত ৫২ বছরে খুবই কম পঠন-পাঠন, প্রচার ও আলোচনা হয়েছে এবং একই ধারাবাহিকতা মেনে হয়নি তেমন কোনো গবেষণাও। অথচ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আগ্রহী শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কাছে এটি একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও রেফারেন্সযোগ্য গবেষণাক্ষেত্র হয়ে ওঠতে পারত।
নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা উল্লিখিত ঘোষণাপত্র সম্পর্কে প্রায় তেমন কিছুই জানে না বা জানতে পারছে না এবং এ না জানাটা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের জ্ঞানকে খুবই খন্ডিত করে রাখছে। অন্যদিকে এ ঘোষণাপত্রই যে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ, যুদ্ধ পরিচালনা ও স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম বছরে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধান বা রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নির্দেশিকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, সে সম্পর্কে সাধারণের মধ্যেও ব্যাপকভিত্তিক কোনো স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি বা ওঠতে পারেনি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের গৌরব। মহান ৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের রয়েছে অবিস্মরণীয় ভ‚মিকা। স্বাধীনতার ঘোষণা বা জন্ম সনদ এবং সংবিধান রক্ষার দায় তাদেরও আছে। কারণ তারা সংবিধান রক্ষার জন্য শপথপ্রাপ্ত। সেনাবাহিনী যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তবে তা হবে শপথ ভঙ্গের শামিল। সংবিধান সমুন্নত রাখা তাদের গুরু দায়িত্ব। সংবিধানের ৬৫ নং ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এহেন অপচেষ্টা রোধ করতে পারে। কিন্তু তারা নিরব কেন? এ প্রশ্ন আমি রেখে গেলাম আপনাদের কাছে।
আমাদের মহান সংবিধান শুরু হয়েছে 'আমরা' শব্দটি দ্বারা। আমরা সকলেই এই রাষ্ট্রের মালিক। তাই সংবিধানে বলা হয়েছে দা উইল অফ দ্যা পিপুল ইজ সুপ্রিম। অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছাই সর্বোচ্চ। কিন্তু ধর্মাশ্রয়ী ভন্ডরা বলে জনগণের ইচ্ছে নয়, স্রষ্টার ইচ্ছাই সর্বোচ্চ। কাজেই তারা আমাদের দেশের প্রচলিত কোন আইন মানে না। মানেনা সংবিধান ও স্বাধীনতার ঘোষণা। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ওরা কি আমাদের আদিম যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়? আমি আপনাদের কাছে এই প্রশ্নটিও রেখে গেলাম।
ধর্ম এবং রাজনীতি কি এক? তা মোটেও নয়। একজন কুটনীতিবিদই একজন সফল রাজনীতিবিদ। ক‚টনীতিতে মিথ্যা বলা পাপ। এটা নেই। কিন্তু ধর্মে মিথ্যে বলা মহাপাপ। এ ধরনের অসংখ্য বৈপরীত্য ধর্ম এবং রাজনীতিতে রয়েছে। তাই ধর্ম এবং রাজনীতি বিপরীতমুখী এবং সাংঘর্ষিক। সামনে ধর্মাশ্রয়ীদের সাথে মুক্তমনা স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের সংঘর্ষ কি অনিবার্য? আমাদের মাননীয় বিচারপতিগণ সংবিধান রক্ষায় শপথ নিয়েছেন। তারা শুয়োমোটো রুল জারির মাধ্যমে এহেন অপচেষ্টা রোধ করতে পারেন । কিন্তু তারাও নীরব কেন?
আমি এই প্রশ্নগুলোও রেখে গেলাম আপনাদের কাছে। আবার আপনাদের সাথে দেখা হবে। অন্য কোন লেখার মাধ্যমে। সে পর্যন্ত আপনারা সবাই সুস্থ থাকুন। ভালো থাকুন। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা