অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় আট লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন। এবারের বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম করা হয়েছে ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। কিন্তু বাজেটের এমন কিছু দিক রয়েছে যা শিরোনামের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে যা করা দরকার তার অনেক কিছুই নেই প্রস্তাবিত বাজেটে। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানের কথা থাকলেও ইন্টারনেট সেবা ও মোবাইল ফোনের কলরেটে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন টকটাইম ও ইন্টারনেট সেবায় ১৫ শতাংশ চালু থাকা ভ্যাট আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ফোনে রিচার্জ করার সময় এই অর্থ কেটে রাখা হয়। প্রস্তাবিত বাজেট পাশ হলে একশ টাকা রিচার্জে মিলবে ৭২ টাকা। প্রতি ১০০ টাকার টকটাইম পেতে হলে ১৩৩ টাকা ২৫ পয়সার জায়গায় এখন ১৩৯ টাকা রিচার্জ করতে হবে। ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সরকার ২৮ টাকা শুল্ক-কর পাবে। ফলে সাধারণ গ্রাহক ৭২ টাকা ব্যবহার করতে পারবেন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর প্রথমবার ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। পরে কয়েক দফা বাড়িয়ে তা ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল। এখন তা বাড়িয়ে করা হলো ২০ শতাংশ। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটে করারোপ স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক নয়।
প্রতি বছর বাজেট আসে, আলোচনা হয়, সমালোচনার পর তা পাশ হয়, কিন্তু সত্যিকারার্থে মানুষের ভাগ্য বদলায় না। বাজেটে সবার দৃষ্টি থাকে আয়করের দিকে। বিশেষ করে যারা চাকরিজীবী তাদের জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাবিত বাজেটে দেখা যাচ্ছে, করমুক্ত আয়ের সীমায় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। করধাপের ক্ষেত্রে এবার কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। যাদের আয় বেশি তাদের ক্ষেত্রে আয়কর বেশি দিতে হবে। এবারের বাজেটে করধাপে সর্বোচ্চ স্তর নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ শতাংশ। যাদের মোট বাৎসরিক আয় ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি তাদের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ আয়কর প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি আয় হলে সেই আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে।
বাজেটে রূপচর্চা সামগ্রীর ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। হাত, নখ, পায়ের প্রসাধন সামগ্রী, লিপস্টিক, চুল পরিচর্যা সামগ্রীতে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। বিধায় কসমেটিক্স আইটেমের দাম বাড়তে পারে। প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এবার প্রায় অর্ধশত পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট হার এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। এতে সব শ্রেণির মানুষকে সমানভাবে ভ্যাটের ভার বইতে হবে। এ তালিকায় থাকা মোবাইল ফোন, সিসি ক্যামেরা, ক্যাবল, এসি ও ফ্রিজের মতো ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দাম বাড়তে পারে। এবার দেশীয় ইলেকট্রনিক পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়তে পারে। এসি ও এলইডি টিভি তৈরির উপকরণ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর ফলে দেশে এসি ও টিভির দাম বাড়তে পারে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইকুইপমেন্ট ও ইরেকশন ম্যাটেরিয়াল আমদানিতে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এতে বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে পণ্যের উৎপাদন খরচে।
দেশে এখন যেকোনও আমদানিকারক কোনও শর্ত ছাড়াই ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিয়ে সব ধরনের কম্পিউটার ও প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারেন। এই সুবিধা প্রত্যাহার করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এতে কম্পিউটারের দাম বাড়তে পারে। বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত পানির ফিল্টারেও হাত দিয়েছে সরকার। এই ফিল্টার আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। দেশে উৎপাদন হওয়ায় পানির ফিল্টার আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। তাই গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত পানির ফিল্টারের দাম বাড়তে পারে। এছাড়া নতুন বাজেটে আমসত্ত্ব, ফলের জুস, ম্যাঙ্গো বার ও জুস, তেঁতুলের জুস, পেয়ারার জুস, আনারসের জুস ইত্যাদি উৎপাদনে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থ্যাৎ আমসত্ত্ব ও জুসের মতো মখোরচক খাবারেও নজর পড়েছে সরকার।
প্রস্তাবিত বাজেট পাশ হলে রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যয়ও বেড়ে যাবে। কেন না কিছু শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে রেফারেল বা বিশেষায়িত হাসপাতালের শুল্ক ছাড় সুবিধায় ১ শতাংশ শুল্কে মেডিক্যাল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির সুযোগ রয়েছে। আগামী বাজেটে দুই শতাধিক মেডিক্যাল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এখানেই শেষ নয়, কমিউনিটি সেন্টার কিংবা কনভেনশন সেন্টারে বিয়ে, জন্মদিন কিংবা যে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গেলে আয়কর রিটার্ন দেখাতে হবে। আয়কর রিটার্নের প্রমাণ ছাড়া কমিউনিটি সেন্টারে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করা যাবে না।
লেখক: হাসান আল বান্না, সাংবাদিক ও কলামিস্ট