বাংলাদেশে সাড়ে ১৫ বছর ধরে সুবিধাভোগী বেশকিছু মহলের মানুষ; যারা নিজেকে আওয়ামীপন্থি হিসাবে জাহির করেছেন, তাদের অনেককেই দেখা মিলছে এখন ভিন্ন চেহারায়। রাতারাতি ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তারা এখন আওয়ামীবিরোধী সাজার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার অপচেষ্টা করছেন।
ইতোমধ্যে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের চরম পরিণতি হওয়ার পর অনেককেই ভিন্ন চেহারা দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতার পালা বদলের কারণে এর মধ্যে দেশে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি লোকেরা দলে দলে শোডাউন দেওয়া শুরু করেছে। আর তাদের সঙ্গে শামিল হতে দেখা যাচ্ছে এসব সুবিধাভোগী বর্ণচোরা গোষ্ঠী। যাদের অনেকে ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও ডিগবাজি দিয়েছিলেন।
বিএনপি ও জামায়াতপন্থি কয়েকজন নেতার দাবি, এখন প্রধান সমস্যা হলো সবাই আওয়ামীবিরোধী সাজার অপচেষ্টা করছে। যারা গত সোমবার (৫জুলাই) দুপুর পর্যন্ত আওয়ামীপন্থি ছিলেন, তারা এখন বলছেন, তিনি নিরপেক্ষ এবং কেউ কেউ একধাপ বাড়িয়ে নিজেকে বিএনপি কিংবা জামায়াত-শিবিরের কর্মী হিসাবেও দাবি করছেন। তবে যারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে বিভিন্ন ট্যাগ দিয়ে অন্যায়ভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন-দুর্নীতি করেছে, তাদের ক্ষমা করা হবে না বলেও জানান নেতারা, তাদের বিচার হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির কেন্দ্রীয় কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, ক্ষমতা আর আগের মতো দলবাজদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে না। দলবাজমুক্ত একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র শুরু থেকে গড়ে তুলতে না পারলে পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরও খারাপ হবে। একটি মহল তো দলীয় সাইনবোর্ড ব্যবহার করে বিশেষ সুবিধা নিতে চাইবে। কিন্তু আগের মতো এগুলো যদি চলতে থাকে, তাহলে যে বীর ছাত্ররা রাষ্ট্র মেরামতের জন্য বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়েছেন, তাদের স্বপ্ন বিফলে যাবে। তাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। কিন্তু আমরা তো এ আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দিতে পারি না।
তারা বলেন, এজন্য আমরা বলেছি, যদিও আমাদের ওপর আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় তেকে নানাভাবে নিপীড়ন করেছে; তবুও আমরা চাচ্ছি একটি সত্যিকার গণতন্ত্রমুখী রাষ্ট্র গড়ে উঠুক। তাই দলীয় পরিচিতি কোনো মানদন্ড হতে পারে না। তবে যারা অতীতে ব্যক্তিস্বার্থে প্রশাসনকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করেছেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেসুমার দুর্নীতি করেছেন, তাদের ক্ষমা করা হবে না। তাদেরকে ঘরে-বাইরে বয়কট করাসহ তালিকা করে শাস্তির মুখোমুখি করা হবে। তালিকা করার সময় পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। মনগড়া কিংবা প্রতিপক্ষ মনে করে কাউকে দুর্নীতির তালিকায় যুক্ত করা হবে না। তবে আমরা সবাই কমবেশি জানি কারা কীভাবে অবৈধভাবে টাকা কামিয়ে দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক প্রভাবশালী নেতা এবং এমপি-মন্ত্রীরা জীবননাশের আশঙ্কায় আত্মগোপনে চলে গেছেন। আবার গোপনে দেশ ছেড়েছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার দেশ ত্যাগের চেষ্টাও করছেন। দলের সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরাও গা ঢাকা দিয়েছেন। অনেকে হামলা-মামলার ভয়ে আত্মীয়-স্বজনের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার আওয়ামী লীগের শরিক ১৪ দলের নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে ১৪ দলের প্রথম সারির বাম নেতাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি দলীয় নেতাকর্মীরাও তাদের খোঁজ পাচ্ছেন না। তবে কেউ কেউ নিজ বাড়িতে অবস্থান করলেও আতঙ্কে রয়েছেন।
বাম দলগুলোর একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, সারা দেশে বাম দলগুলোর বিশেষ করে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের ঢাকাসহ সারা দেশের কার্যালয়গুলো আক্রমণ করা হয়েছে। পাশাপাশি নেতাদের বাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই আত্মগোপনে আছেন। দলীয় প্রধান, দলের শীর্ষ নেতা এবং এমপি-মন্ত্রীদের দেশ ছাড়া ও আত্মগোপনের বিষয়টি ভালো ভাবে নিচ্ছে না আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, যারা দলের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন, সবাই কর্মীদের বিপদের মুখে রেখে দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ কর্মীরা এখন হামলার শিকার হচ্ছে। তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মারপিট করা হচ্ছে। তারা জানেন না এমন অবস্থায় কী করতে হবে। একই সাথে এই সংকটে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তারা।
ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় এক বাম নেতা বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতে পাক হানাদার বাহিনীর বন্দুকের মুখে দেশবাসীকে ফেলে রেখে শেখ মুজিবুর রহমান যেমন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রেফতার হয়ে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন; তেমনি শেখ হাসিনা মন মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বিপদেফেলে পালিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তবে হাসিনার পদত্যাগ ও পালিয়ে দেশ ত্যাগ করার বিষয় নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন বিশ্লেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ব্রি. জে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে গেলেন। গণমাধ্যমে প্রাণহানির যে চিত্র উঠে এসেছে, বাস্তবে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। আরও কত মরদেহ কোথায় পড়ে আছে, কত গণকবর হয়েছে, কতগুলো নিরীহ মানুষের প্রাণ ঝরেছে! তিনি তো চলে গেলেন। এখন এর জবাব দেবে কে?
সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কিছু মানুষ আগুনে পুড়ে যাওয়া কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের জিনিস-পত্র নিয়ে যাচ্ছে। উৎসুক জনতার অনেকেই এই সময় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সমনে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তবে আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের কোন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সেখানে দেখা যায়নি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের একাধিক তৃনমূল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে বলেন, আগের দৃশ্যপট আর এবারের দৃশ্যপট এক নয়। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা বীরবেশে দেশে ফিরেছিলেন। এবার আন্দোলনে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। শুধু তাই নয়, পদত্যাগ করে তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গেছেন।
দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, দলীয় সভাপতির ওপর তাদের যে আস্থা ও বিশ্বাস ছিল তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তিনি পরিবার নিয়ে নিরাপদে দেশ ছেড়ে গেলেও বিপদে ফেলে গেছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মীদের। নিজে বাঁচলেও পুরো দলকেই ঝুঁঁকিতে ফেলে গেছেন সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। যদি ক্ষমতা ছেড়েই দেওয়া হবে তবে কেন শেষ মুহূর্তে দলের নেতাকর্মীদের আন্দোলন রুখে দিতে মাঠে নামানো হলো- এমন প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে।
অন্যদিকে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, তার পরিবার আর রাজনীতি করবে না। সুতরাং অনিশ্চিত সময়ে দলের অবস্থা এবং দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টিও অনিশ্চিত। পাশাপাশি একনাগাড়ে দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় থাকাকালে দলের দিকে মনোযোগ দেননি শীর্ষনেতারা। ফলে বঞ্চিত নেতাদের অভিমান বেড়েছে। ইতোপূর্বে বঞ্চিত নেতাদের একটা অংশ দলের কার্যক্রম থেকেও বিরত থেকেছেন। সুতরাং এই দলের সুদিন কবে আসবে সে নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারবে না বলে অভিমত অনেকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসিনার মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী দুই সদস্য জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা দেশে থেকে যদি জেলে যেতেন, তা হলে হয়তো তার দলের কর্মীরা এতটা বিপদে পড়তেন না। বাংলাদেশের প্রাক্তন এবং প্রয়াত সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের উদাহরণ টেনে তারা বলেছেন, এরশাদ স্বৈরাচারী ছিলেন। কিন্তু গণ অভ্যুত্থানে যখন তার সরকারের পতন হয়, তখন তিনি দেশ ছেড়ে পালাননি। বরং জেলে গিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল আ’লীগের নেত্রী এমন করবেন, তা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা দুই নারীর একজন হাসিনা (৭৬) যিনি পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। কর্তৃত্ববাদের ধারায় চলমান সাড়ে ১৫ বছরের একটানা আওয়ামী শাসনের পর শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির দাবিতে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভকারীরা রাজধানী ঢাকায় গত ৫ জুলাই একত্রিত হওয়ায় ঘটনা প্রবাহের এক আশ্চর্য মোড়ে সেনাপ্রধান হাসিনার পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। সমর্থকদের দ্বারা মানবতার জননী আখ্যায়িত হাসিনা একটি নড়বড়ে অর্থনীতির মধ্যে টানা চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত ও পঞ্চমবারের মতো ক্ষমতায় আসার মাত্র সাত মাস পর পদত্যাগ করেন। তবে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় উত্থানের সাথে তার নিহত পিতা শেখ মুজিবের প্রভাব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল।