বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সমাবেশ থেকে ধ্বংস, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ত্যাগ করে ভালোবাসা ও শান্তির সমাজ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে।
গতকাল বুধবার দুপুর ২টা থেকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। দীর্ঘ দিন পর ভয়ভীতিহীন মুক্ত পরিবেশে বাঁধভাঙ্গা উল্লাস নিয়ে দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকরা সমাবেশে যোগ দেন। আনুষ্ঠানিক সমাবেশ কার্যক্রম শুরুর আগেই যা রূপ নেয় জনসমুদ্রে। সমাবেশের ব্যাপ্তি কাকরাইল,নাইটিংগেল মোড়, মৎস্যভবন, পল্টন, ফকিরাপুল, আরামবাগে পযর্ন্ত ছড়িয়ে পড়ে । তারা বিভিন্ন ইউনিট থেকে ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে এতে যোগদেন।
স্লোগান মুখরিত সমবেশে প্রচার করা হয় বিএনপির চেয়ারর্পাসন বেগম খালেদা জিয়ার রেকর্ডকৃত বক্তব্য প্রচার করা হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ”মেধা, যোগ্যতা ও জ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। শোষণহীন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হবে। সব ধর্ম–গোত্রের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শান্তি, প্রগতি, সাম্যের ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে আসুন, আমরা তরুণদের হাত শক্তিশালী করি। ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি।”
তারেক রহমান আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশের চলমান অর্জনকে নষ্ট করতে ষড়যন্ত্র চলছে। বিএনপির নামেও কেউ যদি অপকর্ম করতে চায় তাকে আইনের হাতে তুলে দিন। কেউ যদি নিয়ম ভঙ্গ করে তার বিরুদ্ধেও পুলিশের কাছে অভিযোগ দিন। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। বিচারের ভার দয়া করে নিজ হাতে তুলে নেবেন না।
সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রশাসনকে আমরা সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে রাষ্ট্রপতি যেন নির্দেশ দেন সে আহ্বান জানাবো। একইসঙ্গে দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে তিন মাসের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের প্রায় ৬০ লাখ নেতাকর্মী সরকার বন্দি করেছিল। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্রজনতা যখন আন্দোলন করেছিল আমরা তাদের সমর্থন জানিয়েছিলাম। এরপর থেকে ফ্যাসিস্ট সরকার আমাদের ১১ হাজার নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করেছে। কিন্তু সব কিছু পেরিয়ে বাংলার ছাত্রজনতা বিজয় কেড়ে নিয়ে এসেছে। এই বিজয় ছাত্রজনতা ও নেতাকর্মীদের। আমাদের বিজয়কে কেউ যাতে ছিনিয়ে নিতে না পারে সে জন্য সকলকে সজাগ থাকতে হবে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা একটি মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাই, সাম্যের রাষ্ট্র গড়তে চাই। বর্তমানে আমাদের এই বিজয়কে নস্যাৎ করার জন্য যারা কাজ করছে তারা তাদেরই প্রেতাত্মা। নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান থাকবে আপনারা কোনও আগুন দেওয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়িত হবেন না। ক্ষোভ প্রকাশ করে আইন হাতে তুলে নেবেন না। যারা এ সকল ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকবে, দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইবে তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, আমাদের চাওয়া একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন। এটা করার জন্য সেনাপ্রধান দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা আশা করছি, আপনারা এটা করতে পারবেন। গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, আমাদের চাওয়া একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন। আর নির্বাচনের পথে উত্তরণের জন্য সেনাপ্রধান দায়িত্ব নিয়েছেন। আমি আশা করি, আপনি সেই দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবেন। আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে বিনা শর্তে আপনাকে বিশ্বাস করেছি। তাই জনগণকে আশাহত করবেন না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখনও কোনো সরকার নাই। আমাদের সেনাবাহিনী দায়িত্ব নিয়েছেন। সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এখন একটি সরকার উপহার দিতে হবে। সরকারে কে আসবে না আসবে সেটা আমাদের বিষয় নয়। কারণ, একটি সরকার দরকার। সরকার ছাড়া দেশ চালানো সম্ভব নয়। সে কারণে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা করতে হবে।
সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির স্থাযী কমিটির এ সদস্য বলেন, যেহেতু আপনাদের মানুষ বিশ্বাস করে, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন জনগণের ভোটের অধিকার দিতে হবে। কে প্রধান উপদেষ্টা হবে সেটা নিয়েও আমাদের মাথা ব্যাথা নাই। আমাদের মাথা ব্যাথা একটাই, নির্বাচন দিতে হবে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যেমে একটি সরকার গঠন করতে হবে।
সমাবেশে স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, এ দেশের ছাত্র সমাজ, যুব সমাজ, সাধারণ মানুষ একটি পরিবর্তনের জন্য আশা করছে। যেহেতু শহীদ জিয়ার সঙ্গে রাজনীতিকরেছি, তার আদর্শ আমাদের মাঝে আছে। তাই আমাদের বিশ্বাস সেই পরিবর্তন আমরাই করতে পারব। নজরুল ইসলাম খান বলেন, দেশনেত্রীকে আমরা জীবিত অবস্থায় মুক্ত করতে পেরেছি বলে আমরা আনন্দিত। আমাদের ভাই তারেক রহমানকে একই ভাবে মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনবো।
নজরুল ইসলাম খান আরও বলেন, যে তরুণরা এই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে তাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা দেশকে মুক্ত করতে পেরেছি। তাদের অবদানের কথা স্বিকার করে আমরা একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলব। জনগনের কাছে দায় থাকবে এমন একটি সরকার আমরা গঠন করতে চাই।
বিভিন্ন এলাকা থেকে যোগ দেয়া স্থানীয় পর্যয়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে যাত্রাবাড়ী এলাকার বিএনপির কর্মী আবুল কালাম আজাদ বলেন, আগে সমাবেশ করলেই পুলিশের হামলা, ধরপাকড়, গ্রেপ্তারের ভয় ছিল। কিন্তু এখন আর তা নেই। বহুদিন পর আজ নিশ্চিত মনে সমাবেশ করতে পারছি। শুধু আবুল কালাম নয়, এমন কথা বলেন বিএনপির প্রায় প্রত্যেক নেতাকর্মীর। জুরাইন থেকে আসা বিএনপি কর্মী সবুজ বলেন, স্বৈরাচারের হাত থেকে দেশ মুক্ত হয়েছে। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীকে দিনের পর দিনে জেলে আটকে রাখা হয়েছিল, আজ তারা মুক্তি পাচ্ছেন। আমাদের জন্য আজ আনন্দের দিন, এক আতঙ্কবিহীন সমাবেশের দিন। সবুজবাগের মুস্তাকীম বলেন, বছরের পর বছর আমাদের নির্যাতিত হতে হয়েছে ,অন্যায়ভাবে মার খেতে হয়েছে। আজ সত্যিই আমরা স্বাধীন হয়েছি। সমাবেশে আসার জন্য সকাল থেকেই উৎসাহী ছিলাম। আমরা বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী একসাথে সমাবেশে এসেছি। এর আগে, সমাবেশ ঘিরে সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাক, বাস এমনকি হেঁটেও আসতে দেখা যায় বিএনপি কর্মীদের। সবার মুখেই ছিল দেশ স্বাধীনের স্লোগান। আসার পথে কোথাও বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি বলে জানান তারা।
সমাবেশকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টন ও এর আশপাশের এলাকায় যানজট বেড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ভিআইপি সড়কে যান চলাচল। কোনো ট্রাফিক পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি দেখা যায়নি সমাবেশের আশপাশে।